সেই এপিকের ট্র্যাজিক মলাটে…

উত্তেজনায় একদম টানটান সোজা হয়ে বসলেন দেশটির সব থেকে ক্ষমতাধর ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি, সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন আগেভাগে, একসাথে বিজয় উদযাপন করবেন বলে।

মুখে উদ্বেগের ছাপ, হাত দুটো জড়ো করে স্থির তাকিয়ে আছেন মাঠের দিকে, হোক প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাস্তায় বড় স্ক্রিনে খেলা দেখতে থাকা ক্লাস নাইনে পড়া খেলাপাগল ছেলেটা, সবার মনোযোগ একদিকেই, সমবেত প্রার্থনায় দেশের প্রায় সব মানুষ। ট্রফিটা থেকে দূরত্বটা খুবই কমে এসেছে, চিরশত্রুদের বিপক্ষে জয় দিয়ে মহাদেশের সেরা হবার এমন মোক্ষম সুযোগ আর আসেনি।

দুরুদুরু বুকে প্রস্তুত হলেন আব্দুর রাজ্জাক, এমন পরিস্থিতিতে ব্যাটটা কখনো ধরা হয়নি তাঁর, তাও চিরঅস্বস্তি ডানহাতি পেসের সামনে। চিমার কিছুটা আউট সাইড লেগে পিচ করা বলটাকে রাজ্জাক চাপের মুখে চিকি মেরেই বাকি চারটা রান তুলে নিতে চাইলেন, কিন্তু বলের লেন্থই ধরতে পারলেন না, অসহায়ভাবে লেগস্টাম্প এর বেলটা পড়ে যেতে দেখে অপরপাশে রিয়াদের দিকে করুণ দৃষ্টি হেনে মাথা নিচু হাঁটা দিলেন।

গ্যালারিটা যেন হঠাৎ করে চুপসে গেল। অন্যপাশে সেট ব্যাটসম্যান রিয়াদ হয়তো তখন হাত কামড়াচ্ছেন, চাপে উত্তেজনায় মিডফিল্ডে একটা বাড়তি রান নেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলে শেষ দুই বল তিনি স্ট্রাইকে থাকলে হয়তো ইতিহাসটা অন্যভাবে লিখতে পারতেন।

শেষবলে লাগে চার, শাহাদাত এলেন ক্রিজে, ব্যাট হাতে আনাড়ি, একটা টেস্ট ফিফটি থাকলেও নেমেই চার-ছয়ের ব্যাটসম্যান ছিলেন না কখনোই। তবু এই তার সুযোগ, এমন ম্যাচে শেষ ওভারে ১৯ রান দেয়ার অপরাধ ভুলিয়ে দেয়ার, হিরো হয়ে ওঠার। নাজিমুদ্দিন, নাসির হোসেনরাও হয়তো মাপ পেয়ে যাবেন অযথা স্নায়ুচাপে ভুগে দলকে ভোগানোর, সাকিব-তামিমদের ইচ্ছাশক্তি, একদিনের পরিশ্রমের পূর্ণতা শাহাদাতই দিতে পারেন।

মাত্র চারটা রান, কতভাবেই তো হতে পারে! ব্যাটের কানায়টানায় লেগে, আলগোছে তুলে দেয়া বলও ফিল্ডারকে ফাঁকি দিয়ে পেস কাজে লাগিয়ে সীমানার বাইরে ছুটে যায়! কিন্তু ভাগ্যদেবী কেন যেন একরাশ অভিমান জমা রেখেছেন বাংলাদেশ নামটার প্রতি!

চিমার কিছুটা স্লোয়ার ধরণের ঝুলিয়ে দেওয়া বলের জবাব ছিল না শাহাদাতের। কোনমতে বল ব্যাটে লাগিয়ে প্রান্ত বদল করা মাত্রই সরফরাজের হিংস্র উল্লাস শোনা গেল। চোখের পানি সামলানো কষ্ট হয়ে উঠলো রিয়াদের।

দর্শকদের ম্লান হয়ে আসা অন্ত:সারহীন হাসি কিংবা ড্রেসিংরুমে তামিম ইকবালের শূন্য অভিব্যক্তি, গ্যালারির কান্না মিরপুর স্টেডিয়াম যেন শ্মশানপুরী হয়ে উঠছিল। তামিম-সাকিব-মুশফিকদের কান্নায় এই এশিয়া কাপ একটি ট্রাজেডি কাব্যই হয়ে রইল। কিন্তু এ তো হবার ছিল না!

এ আসরে বাংলাদেশের গল্পটা যে ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর মনোবলের।

প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের সাথে সদ্য বাজেভাবে সিরিজ শেষ করা বাংলাদেশ প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিল পাকিস্তানকে। শুরুতে তামিম, শেষদিকে সাকিব লড়ে গেলেও উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে ফিনিশ দিতে পারেন নি, তবে নাসির চেষ্টা করেছিলেন। ২১ রানে হেরে টুর্নামেন্ট শুরু করে বাংলাদেশ।

পরের ম্যাচে কোহলি, গম্ভীরের সেঞ্চুরিতে শ্রীলঙ্কাকে ৫০ রানে হারায় ভারত। পরের ম্যাচে আইজাজ চিমার বোলিং তোপে ১৮৮ রানে গুটিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের কাছে ৬ উইকেটে হারে শ্রীলঙ্কা

পরের ম্যাচে হারলেই বাদ এমন সমীকরণ নিয়ে রানার মৃত্যুবার্ষিকীতে ভারতের সাথে খেলতে নামে স্বাগতিক বাংলাদেশ। চতুর্থ উইকেট জুটিতে কোহলি-টেন্ডুলকারের ধ্রুপদী ১৪৮ রান, পরে রায়না-ধোধিকে সঙ্গে নিয়ে দলকে ২৮৯ রানের বেশ ভাল সংগ্রহ এনে দেন শচীন টেন্ডুলকার। এ ম্যাচেই সাকিবের বলে হালকা পুশে পেয়ে যান সেই বহুল প্রতীক্ষিত সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি।

জবাবে এ ম্যাচেও অনেকটা আগের ম্যাচের চিত্র, শুরুতে ইনিংসের ভিত্তি গড়ে দেন তামিম-জহুরুল, পরে মিডলে হাল ধরেন সাকিব-নাসির। তবে আগের ম্যাচে যে জিনিসটার অভাবে হারতে হয়েছিল, সেই ফিনিশিংয়ের দায়িত্ব অসাধারণভাবে পালন করে ম্যাচের সব আলো কেড়ে নেন অধিনায়ক মুশফিক। তিন ছক্কা, তিন চারে ২৫ বলে ৪৬ রানের ঝড় তুলেন তিনি। সবাইকে চমকে ভারতকে হারিয়ে ফাইনালের হিসাব-নিকাশে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ।

এই ম্যাচ দিয়েই শুরু হল বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের লড়াইয়ের রোমাঞ্চকর উত্তেজনা। এককালের জনপ্রিয় কিন্তু বর্তমানে সবচেয়ে একপেশে ব্যাটেল ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সবশেষ এই ম্যাচেই কিছুটা রোমাঞ্চ খুঁজে পেয়েছিল দর্শকরা। জামশেদ-হাফিজের সেঞ্চুরিতে ৩২৯ রানের পাহাড় গড়ে পাকিস্তান। কিন্তু এ ম্যাচেই আল্টিমেট রানচেজার হিসেবে নিজের সক্ষমতা প্রকাশ করেন কোহলি, ১৮৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে পাকিস্তানকে ৬ উইকেটে হেসেখেলেই হারায় ভারত। টিকিয়ে রাখে ফাইনালের আশা।

জিতলেই ফাইনাল, হারলে ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হবে। এমন সমীকরণ নিয়ে শ্রীলংকার বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। শুরুতে ব্যাটিংয়ে নামা লঙ্কানদের তিন ব্যাটিংস্তম্ভ দিলশান, মাহেলা, সাঙ্গাকারার উইকেট তুলে নিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে দেন নাজমুল।

পরে কাপুগেদারা, থারাঙ্গা, থিরিমান্নেরা চেষ্টা করলেও ২৩২ এর বেশি নিতে পারেননি দলকে। জবাবে বাংলাদেশ বৃষ্টি আইনে ৪০ ওভারে টার্গেট পায় ২১২ রানের। ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া বাংলাদেশ আরো একবার রক্ষা পায় তামিম-সাকিব-নাসিরের হাত ধরে, রিয়াদ-নাসিরের ৭৮রানের হার না মানা জুটিতে ৫ উইকেটের জয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ।

আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামা ভারসাম্যপূর্ণ পাকিস্তানকে শুরু থেকেই টুঁটি চেপে ধরে। নিয়মিত উইকেট পতনে যেখানে ২০০ করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছিল পাকিস্তানের, সেখানে ২৩৮করে ফেলার পিছনে বড় কৃতিত্ব আফ্রিদি, সরফরাজ এবং শাহাদাতের। আফ্রিদির ঝড়ো ব্যাটিং দলকে ২০০ পার করার মত স্টেজে আনে, আর সরফরাজ এক শাহাদাতকেই টার্গেট করে আক্রমণ করতে করতে বেশকিছু রান তুলে ফেলে। শেষ ওভারে শাহাদাত ১৯ রান গচ্চা দেন, দুই নো-বল থেকেই আসে ৮ রান। এই ওভারই হয়ে ওঠে ম্যাচের অন্যতম ভাইটাল ওভার।

জবাবে তামিমের দুর্দান্ত শুরুর অন্যপাশে দেখা যায় নাজিমুদ্দিনের হাঁটু কাপাকাপি, ৫২ বল খরচ করে ১৬ রানের ‘মহামূল্যবান’ ইনিংস খেলে তিনি আউট হবার পর পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা নাসিরকেও দেখা যায় অতিরিক্ত ডিফেন্সিভ মুডে। তামিম টানা চার ফিফটি করে আউট হলে সাকিব হাল ধরে দারুণ খেলতে থাকলেও নাসির ছিলেন নিষ্প্রভ।

তাদের ৮৯ রানের জুটি প্রায় ২০ ওভার খরচ করে ফেলে, যা বেশ প্রভাব ফেলে। ৬৩ বলে ২৮ রান করা নাসির, ৬৮ রান করা সাকিব আউট হলে খেই হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। শেষদিকে, মাশরাফির ৯ বলে ১৮ আবারো সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন। কিন্তু শেষ ওভারের ক্লাইমেক্স এই আসরকে বাংলাদেশের আজীবনের আফসোসে পরিণত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link