প্রস্থান মানেই তো আর স্মৃতির গহীনে হারিয়ে যাওয়া নয়। প্রস্থান তো আরও একটা নতুন শুরু। সেই শুরুটা একটু ভিন্নভাবে করা যায়। স্টেডিয়াম ভরা দর্শকদের নয়ন জলে ভেসে করা যায়। সতীর্থদের গভীর শ্রদ্ধাভরা বুকের সাথে শেষ দফা বুক মিলিয়ে নিয়ে। ক্যামেরার সব আলোর ঝলকানির সামনে অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া, আর উঁচিয়ে ধরা হাতে বিদায় বলেও শুরু করা যায়।
নতুন দিনটা শুরু করার আগে প্রতিপক্ষের ‘গার্ড অব অনার’ নিয়েও শুরু করা যায়। তবে উপমহাদেশের ক্রিকেটাররা ঠিক সেটাতে অভ্যস্ত নয়। তাঁরা নিজেদের বরং কলুষিত করে, পাহাড়সম সমালোচনার বোঝা কাঁধে নিয়ে বিদায় নেন। তাদের আর নতুন করে শুরু করাটা হয়ে ওঠে না।
হালের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ঘটনাটা আরও একবার তেমনই এক উদাহরণের জন্ম দিল। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নেই, সে কথা বেশ পুরনো। তিনি বাদ পড়েছেন। সেটা খুব স্বাভাবিক। তবে তিনি সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ভুল প্রমাণ করতে চান। করতে চান অতিমানবীয় কিছু। তাইতো তিনি আরও বছর দু’য়েক লড়াই করতে চান জাতীয় দলের তাঁর হারানো জায়গা ফিরে পেতে।
গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা ও ক্রিকেট প্রেমী, সবার মনেই খানিকটা আক্ষেপ অথবা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে বিসিবির উপর। কেননা রিয়াদ সাম্প্রতিক সময়ে অফফর্মে থাকলেও তিনি সর্বদাই ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সেনানী। এবারের বাদ পড়া যে তাঁর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায়ের সুর তুলছে সেটা সবাই ধরেই নিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে তো অন্তত তাঁর বীরত্বগাঁথা ইনিংসগুলোর জন্যে সম্মানের সহিত বিদায় বলা উচিৎ। কিন্তু বিসিবি সেটা করেনি।
ঠিক এখানেই সমস্যার সৃষ্টি। বিসিবি রিয়াদের সাথে কথা বলে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিসিবিরি থেকে বলা হয়েছিল ত্রিদেশীয় সিরিজে মাঠ থেকে রিয়াদকে অবসর গ্রহণ করতে। তবেই তো রিয়াদ পেতে পারতেন একটা নতুন শুরু। শাহরিয়ার নাফিস কিংবা আবদুর রাজ্জাকদের মত করেই তিনি সম্পৃক্ত থাকতে পারতেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে। তবে তিনি সেটা চাইলেন না।
তিনি চাইলেন নিজেকে প্রমাণের আরও একটা সুযোগ। তবে সে সুযোগটা ফিরে আসা বড্ড কঠিন। বয়সটা ৩৭ এর কোটা ছুঁইছুঁই। ঠিক এই সময় আসলে ফিরে আসার নজির খুব কম। হয়ত ভারতের দীনেশ কার্তিকের উদাহরণ টেনে আনছেন রিয়াদ। তবে সেখানেও তো বুঝতে হবে দীনেশ কিংবদন্তিতুল্য ক্রিকেটার হিসেবে কখনোই বিবেচিত হননি ভারতীয় ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু রিয়াদ তো রীতিমত উল্টো মেরুতে করছেন অবস্থান।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের কতশত স্মৃতিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের নাম, তার হিসেবটা বোধহয় খোদ রিয়াদেরও অজানা। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যে ক’জন ক্রিকেটার অবদান রেখেছেন, তাঁর মধ্যে রিয়াদের অবস্থান তো উপরের সারিতেই। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সেঞ্চুরি করবার অনন্য এক রেকর্ডের ভাগিদার রিয়াদ। তিনি তো এক স্টেডিয়াম দর্শকদের সামনে ক্রিকেট ব্যাটটা তুলে রাখার ঘোষণার সুযোগ পেতেই পারেন। তবে তিনি সেটা গ্রহণ করলেন না।
রিয়াদের তো আর বাংলাদেশকে কিছু দেওয়ার নেই। তিনি চাইলেও বয়সের ভারে প্রত্যাশার চাপ সামলে নিজের সেই হারানো দিনে ফিরতে পারবেন না। একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয়ে গেলে সেখান থেকে নিচে নেমে যাওয়ার চাপ সবাই সামাল দিতে পারেনা। এখনই রিয়াদের যে পরিমাণ সমালোচনা তাতে অন্তত জাতীয় দলের জন্যে লড়াই করে যাওয়া হতে পারে তাঁর জন্যে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা।
ঠিক যেমনটা সইতে হয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। লোকমুখে শোনা যায় তাকেও বিসিবি থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার। তবে মাশরাফি রাজি হননি। এরপর রীতিমত কাঁদা ছোড়াছোড়িতে লিপ্ত হয় দুই পক্ষ। কিন্তু ঠিক কবে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ক্রিকেটাররা নিজেরদের ভাল সময়ে বিদায় নেওয়ার অনন্য নজির গড়বেন? আর কতকাল সমালোচনা আর তিরস্কারের দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি করে তাঁরা হারিয়ে যাবেন অতলে? সেটা হয়ত কারওই জানা নেই। এভাবে কি চলতে পারে?
নিশ্চয়ই না, ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট। একদিন এই উপমহাদেশের ক্রিকেটাররা সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। সেদিন হয়ত দর্শকদের মনে আরেকটু আক্ষেপ বাড়িয়ে দেবেন, ‘ইস! আরেকটু উপভোগ করা গেল না।’ আমরাও তাই চাই। ‘কেন যাচ্ছেন না’ বলে বলে ট্রল করতে চাই না, বরং বার বার আক্ষেপ করে বলতে চাই, ‘কেন যাচ্ছেন?’