সিডনি টেস্টের পর মনের অবস্থা যেরকম হয়েছিলো এদিনও ঠিক সেরকমই হচ্ছে। যেকোন প্রশংসাই এই দলের জন্য খুব কম হয়ে যাবে।
গত ম্যাচে ঋষভ পান্ত যখন ৯৭ রানের ইনিংটা খেলছিলেন তখন একটা লেখা শুরু করেছিলাম। লিখতে লিখতেই তিনি আউট হয়ে গেলেন। মন খারাপ হয়ে গেলো। পরে ম্যাচের নাটকীয়তায়, বিহারি-অশ্বিনের বীরত্বে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে আর লেখাটা লিখি নাই।
লেখাটা যেটা শুরু করেছিলাম এভাবে – ‘যে কোন খেলায় অনেক ধরনের খেলোয়াড় থাকে। যেমন – বিলো এভারেজ, এভারেজ, ভালো, খুব ভালো ও ম্যাচ উইনার। কিন্তু যখন কোন খেলোয়াড়কে কাঁটা-বাছা করা হয়, আলোচনা-সমালোচনা, বিশ্লেষণ করা হয়, সবসময়ই ম্যাচ উইনার জাতীয় খেলোয়াড়দের আমি বেশি ডিফেন্ড করি। আমার মনে হয় যারা যে কোন খেলাটা খুব ভালো বোঝেন, তারা সবাই এই কাজটা করেন। যার জন্য আমি সব সময় সৌম্য সরকার আর লিটন দাসকে ব্যাক করেছি। যদিও এখন মনে হয় সৌম্য ঠিক ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের না (নিজেকে ভুল প্রমান হলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবো), ঠিক একই কারণে আমি ঋষভ পান্তকে অনেক জায়গায় ডিফেন্ড করি।
চার টেস্টের সিরিজ ১-১ এ ড্র। ৩ নম্বর টেস্ট চলছে। শেষ দিনে জিততে হলে করতে হবে ৩০৯ রান, হাতে আছে সাড়ে ৬ উইকেট। ম্যাচ ড্র করতে হলেও ব্যাট করতে হবে ৯৮ ওভার। এইরকম অসম সমীকরণের সামনে দাড়িয়ে টিম ইন্ডিয়াকে যদি ম্যাচ জেতানোর স্বপ্ন একজন দেখিয়ে থাকতে পারেন সেটি হলো ঋষভ পান্ত।
ঠিক এসব ইনিংস ঋষভ পান্তরা খেলতে পারেন বলেই রিশাব পান্তদের সবসময় ডিফেন্ড করে যাবো।
এতটুকু পর্যন্ত লিখেছিলাম। কে জানে হয়তো সাতদিন পরেই ঋষভ পান্ত তার সেদিনের খেলা ইনিংটাকেও ছাড়িয়ে যাবেন বলেই হইতো আমি লেখাটা আর শেষ করি নাই। কারণ আমাকে আবার লিখতে হবে। গত ম্যাচ শেষে যে ইনিংসকে বলা হচ্ছিলো ঋষভের জীবনের সেরা ইনিংস, এক সপ্তাহ পরই সবাই তাদের মত বদলে ফেললো। অথবা বলা যায় তাদের মত বদলাতে বাধ্য করলেন পান্ত।
আমি যেখানেই পান্ত নিয়ে কথা বলি সবসময় বলি যে পান্ত নিজের পারফর্মেন্সের ভিক্টিম। কেনো?
২০১৮ আইপিএলে মাত্র ২১ বছর বয়সে এই ছেলে আইপিএলে ৬৮৪ রান করেছে। তাও আবার ১৭৩ স্ট্রাইক রেটে। ২০১৯ আইপিএলে ৪৮৮ রান করেছে। এখন যখন ঋষভ পান্ত জাতীয় দলে সু্যোগ পায় সবার প্রত্যাশা থাকে যে এই ছেলে ১৭০ স্ট্রাইক রেটে আমাকে ৩০ বলে ৫০ রানের ইনিংস উপহার দিবে। নিয়মিত ৭০-৮০ রানের ইনিংস উপহার দিবে।
কিন্তু মানুষ আইপিএল এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পার্থক্য বোঝে না। মানুষের প্রত্যাশার পারদ নিম্নমুখী হয় না। রিশাব পান্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেইল করেন। শুরু হয়ে যায় চারিদিকে সমালোচনা। বলা ভালো, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে ব্যর্থ হন। শুরু হয় সমালোচনা। ঋষভ পান্ত ক্যাচ মিস করলে, স্ট্যাম্পিং মিস করলেই গ্যালারিতে ‘ধোনি ধোনি’ বলে চিৎকার হয়। এসব কিছুই তাকে সহ্য করতে হয়। অথচ ছেলেটার বয়স মাত্র ২১-২২।
ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির পারফরম্যান্স মানুষ মনে রাখে কিন্তু এই ২১ বছরের ছেলে যে ইংল্যান্ডে সেঞ্চুরি করেছে, এই ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে সেঞ্চুরি করেছে সেটা মানুষ মনে রাখে না। অথবা মানুষ মনে রাখলেও খোটা দিতে ভোলে না, ‘সেঞ্চুরি করলে কি হবে ক্যাচ তো ফেলে ২-৩টা। একই ব্যাপার। ক্যাচ মিস করে পোষাইয়া দিছে।’
গত ম্যাচে ওরকম একটা ইনিংস খেলার পরও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন টেস্ট ক্রিকেট খেলার টেম্পারমেন্ট তার আছে কি না। নইলে ৯৭ রানে গিয়ে কি কেউ নাথান লিঁওকে উড়িতে মারতে যায়?
আজকে যখন নামলেন তখন দরকার ৪৩.১ ওভারে দরকার ছিলো ১৬১ রান। হাতে আছে ৭ উইকেট। সাথে পেলেন টিম ইন্ডিয়ার নতুন ‘দ্য ওয়াল’কে। যিনি কিনা অজি পেস ত্রয়ীর বাউন্সার সামলাতে নিজের বুক-পিট,হাত-পা সব পেতে দিয়েছেন। তবু এ দেওয়াল ভাঙা যাবে না।
১৬১ রান ৪৩ ওভারে অসম্ভব নয়। কিন্তু খুব খুব কঠিন। কিন্তু কঠিন কাজটিকেই যদি কেউ সাধ্যের মধ্যে আনতে পারে তিনি হলেন ঋষভ পান্ত। ইন্ডিয়া টিম ম্যানেজমেন্ট তাই মায়াঙ্ক আগারওয়ালের আগে ঋষভ পান্তকে উইকেটে পাঠালো। এই জায়গাটাতে প্রমান হয়ে যায় এই ভারত কেন পূর্বের অন্যান্য দল থেকে আলাদা। এই ভারত যতক্ষণ পর্যন্ত পারা যায়, ততক্ষণ জেতার চেষ্টা করে। আজকেও করেছে এবং জিতেছে।
সিডনি টেস্টের মত আজকেও ইনিংসটা শুরু করলেন দেখে শুনে। প্রথম ৪৬ বলে করেছেন মাত্র ১৬ রান। এর মধ্যেই করে ফেলেছেন ভারতীয় উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্রততম এক হাজার টেস্ট রান।
নিজের শেকিনেস কাটালেন নাথান লিঁওকে মিড অনের উপর দিয়ে বিশাল ছক্কা মেরে। পৌছে গেলেন ২২ রানে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম ইনিংস থেকে টানা ১২ ইনিংসে ২০+ রানের রেকর্ড। যে রেকর্ড আর কারো নেই।
গত ইনিংসে উইকেটে প্রায় সেট হয়ে উইকেট গিফট করে এসেছেন। এই ইনিংসে তা করলে চলবে না। এখন দায়িত্ব অনেক বেশি। দলকে জেতাতে হবে,ম্যানেজমেন্টের আস্থার প্রতিদান দিতে হবে আবারো, যে মাঠে অজিরা ৩২ বছর ধরে হারে না, টিম পেইন যে মাঠে তাঁদের দেখে নিতে চান সেই অহঙ ভেঙে চুরচুর করতে হবে। তাই এই ইনিংসে পান্ত অনেক বেশি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
নতুন বল আসলো। প্যাট কামিন্স এখন পৃথিবীর এক নাম্বার বোলার। এই ম্যাচেও বল করছেন দুর্দান্ত। একটা গ্রুপেও বললাম প্যাট কামিন্স অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচে ফেরাতে পারে। বলা শেষ হলো না কামিন্সের উইকেট নেওয়া শেষ। চেতেশ্বর পূজারার উইকেট নিয়ে ম্যাচে ফেরালেন অস্ট্রেলিয়াকে। তার আগে পূজারা খেলে ফেলেছেন ওয়ান অফ দ্য গাটসিয়েস্ট ইনিংস ইন রিসেন্ট টাইম। কিন্তু তখন টিম অস্ট্রেলিয়ার ভেতরে বিলিফ চলে এসেছে।একে তো নতুন বল তার উপর আবার অনভিজ্ঞ, অফ ফর্মে থাকা প্লেয়ারদের নিয়ে মিডল অর্ডার। বারবার কি সুন্দর,ঠাকুররা ম্যাচ বের করবেন নাকি?
তখনও দরকার ১৯.৪ ওভারে ১০০ রান। ওভার প্রতি পাঁচের উপরে দরকার। অজিদের হাতে আছে নিউ রেড চেরি। ম্যাচ জিততে গেলে আবার না অলআউট হয়ে যায় – এই ভয় নিশ্চয় ছিলো কারো কারো মনে। শুধু ছিলো না একজনের মনে। তিনি রিশাব পান্ত। ৮৪ বলে ৩৪ এ অপরাজিত ছিলেন, সেখান থেকে ফিফটিতে পৌছালেন ১০০ বলে। পরের ১৬ রান মাত্র ১৬ বলে। ২টা ৪ মেরেছেন,একটা ৩। নতুন বলের শঙ্কা-ভীতি উড়িয়ে দিয়েছেন দারুন সব কাভার – এক্সট্রা কাভার ড্রাইভে।
এরকম একটা সিরিজ,এরকম একটা ম্যাচ কি নাটকীয়তায় শেষ না হলে পূর্ণতা পায়? কামিন্স চেষ্টা করলেন নাটকের গল্পটা অস্ট্রেলিয়ার দিকে ঘোরানোর। আগারওয়ালকে আউট করলেন। কিন্তু আসলেন ওয়াশিংটন সুন্দর। ব্যাটিং বোলিংয়ে দারুণ ম্যাচ কাটানো এই খেলোয়াড়ের বাবা নাকি তাঁর ছেলের ফিফটিতে সন্তুষ্ট নন। সেঞ্চুরি হলে নাকি খুশি হতেন।
তো এই ইনিংসে তো আর সেঞ্চুরি করার সুযোগ নেই কিন্তু খেললেন দারুন কার্যকরী আরো একটি ইনিংস। কিছুক্ষণের জন্য ঝিমিয়ে পড়া ইনিংসকে প্রাণ দিলেন কামিন্সকে পরপর ৬ এবং ৪ মেরে। এই দুই বলে ১০ রান যদি ভারতকে আবার ম্যাচ জয়ের ট্র্যাকে ফেরায়, পরের ওভারে নাথান লিঁওকে মারা পান্তের দুই বলে দুই চার সেই জয়ের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
এরপর বাকিটুকু শুধুই নিয়ম রক্ষা। ভারত কখন ইতিহাস গড়বে সেই ক্ষণের প্রতীক্ষা। অপেক্ষার অবসান ঘটালেন ঋষভ রাজেন্দ্র পান্ত। সিডনিতে ৯৭ করেও শুনেছেন কটু কথা, শুনতে হয়েছে ঋষভ প্রতিভাবান হলেও ধোনির মত ফিনিশ করা শেখেনি এখনো, আগের ইনিংসে উইকেট উপহার দিয়ে আশায় হয়েছে সমালোচনা যে এখনো দায়িত্ব নিতে শিখলেন না। কিন্তু এবার আর কোন ভুল করলেন না তিনি। সব আলোচনা – সমালোচনা, দেনা-পাওনার হিসাব চুকালেন তিনি। সাথে সাথে পতন ঘটালেন ৩২ বছর ধরে তৈরি হওয়া অজিদের গ্যাবা সাম্রাজ্যের।