আধুনিক পাকিস্তান ক্রিকেটের মুখপাত্র বাবর আজম। দীর্ঘ সময় পর তিনি ফিরেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে—দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চলমান টেস্ট সিরিজে। প্রত্যাবর্তনের ম্যাচেই ছিল অগণিত প্রত্যাশা, কিন্তু প্রথম ইনিংসে ৪৮ বলে ২৩ আর তৃতীয় ইনিংসে ৭২ বলে ৪২ রান করে ফেরেন এই সাবেক অধিনায়ক।
এক সময়ের পাকিস্তানের ‘গোল্ডেন বয়’ বাবর আজমকে প্রায়ই তুলনা করা হতো তার সময়ের সেরা চার ব্যাটার—বিরাট কোহলি, স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসন ও জো রুটের সঙ্গে। তাঁকে এই কিংবদন্তি ব্যাটারদের ‘ফ্যাব ফোর’-এর অঘোষিত পঞ্চম সদস্যও বলা হত। কিন্তু সেই বাবর আজম এখন যেন নিজের সত্তার সঙ্গেই লড়ছেন। একসময় যিনি ছিলেন এলিগ্যান্সের প্রতীক, এখন তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অনিয়মিত পারফরম্যান্স ও ফর্মহীনতার অভিযোগ।
৩০ আগস্ট ২০২৩—এই দিনেই বাবরের ব্যাট থেকে এসেছিল তার সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। নেপালের বিপক্ষে এশিয়া কাপে করেছিলেন ১৫১ রান। এরপর কেটে গেছে দুই বছরেরও বেশি সময়, কিন্তু তার ব্যাট থেকে আর কোনো শতরান আসেনি। আরও বিস্ময়কর, তার সর্বশেষ টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচির জাতীয় স্টেয়িামে স্টেডিয়ামে।

২০২১ থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাবরের পরিসংখ্যান ছিল দারুণ। এই সময়ে ১০৭ ম্যাচে করেছেন ৫৩০৪ রান, গড় ৪৭.৭৮, সেঞ্চুরি ১৪টি। কিন্তু সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত খেলা ৬৫ ম্যাচে তার রান ২২০৪, গড় নেমেছে ৩১.৪৮-এ, আর সেঞ্চুরি নেই একটিও। সংখ্যাগুলোই বলছে তার গল্প—একসময়ের ধারাবাহিক বাবর আজম এখন রানের খরা জঞ্জালে ক্লান্ত।
তার ইনিংসগুলোতে এখনও ভাল ‘স্টার্ট’ পান, কিন্তু সেই স্টার্টগুলো বড় স্কোরে রূপ নিতে পারছে না। ৩০ বা ৪০ রানে শুরু করা ইনিংসগুলো থেমে যাচ্ছে মাঝপথে, অথচ এক সময় কনভার্সন রেটই ছিল তাঁর বড় শক্তি।
প্রতিপক্ষ দলগুলো এখন তার খেলার ধরণ ও দুর্বলতা নিয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। প্রথমদিকে বাবর রান পেয়েছেন ফ্ল্যাট উইকেটে, যেখানে তার নিখুঁত টেকনিক ও টাইমিং ছিল প্রাণবন্ত। কিন্তু এখন বিভিন্ন কন্ডিশনে তার খেলার ধরন অনেকটাই আগে থেকে অনুমান করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি তার স্ট্যান্সে পরিবর্তন এনেছেন—সাইড-অন থেকে কিছুটা ওপেন স্ট্যান্সে গিয়েছেন— এটা তাঁর ব্যাটিং ব্যালান্স নষ্ট করছে।

তাছাড়া, টি-টোয়েন্টি দলে ফেরার চাপও যেন তার উপর মানসিকভাবে প্রভাব ফেলছে। ব্যাট হাতে আগের মতো আত্মবিশ্বাসী নন, বিশেষ করে স্পিনারদের বিপক্ষে কিংবা ‘নিপ ব্যাক’ ডেলিভারির বিপক্ষে তাকে বেশ অসহায় দেখিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।
বাবরের এই রানের খরা এখন শুধু পরিসংখ্যান নয়, তার এলিট মর্যাদাকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। মাত্র ৩০ বছর বয়সেই ক্যারিয়ারের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একদিকে তরুণ প্রতিভাদের উত্থান, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রতিযোগিতামূলক চাপ—সব মিলিয়ে বাবরের কাঁধের বোঝা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভারী।
এদিকে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডও (পিসিবি) বাবরের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করেছে। এশিয়া কাপ ২০২৫ এবং তার আগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। বোর্ড এখন তরুণদের পক্ষ নিচ্ছে।

সবকিছু মিলিয়ে, বাবর আজমের জন্য সময়টা এক কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তাকে নিজের হারানো ছন্দ ফিরে পেতে নতুন করে লড়াই শুরু করতে হবে। বাবর আজমের ব্যাট আবার কখন হাসবে—এই প্রশ্নটাই এখন পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় রহস্য।










