মৃদু ফিসফাস থেকে কখন যে একটা কথা গুঞ্জন এবং তা থেকে কলরব হয়ে যাবে, সিজিদ্দার ভাষায়, ‘ধরতে পারবেন না।’ কথাটা হল, ‘আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এশিয়ার সেরা টেস্ট ব্যাটার বাবর আজম।’ দিল্লীর ভদ্রলোক গত বছর দুয়েক যা ধ্যাড়াচ্ছেন, তাতে আর কি বলার থাকতে পারে? কথাটা অপ্রিয়, কিন্তু সত্য।
টানা দু’দিন আলোর শহরে বাবর যা খেললেন, তাতে তাঁর ব্যাটিং সূর্য্য সকালবেলার নির্মল তেজ সম্পন্ন নক্ষত্র থেকে হয়ে উঠেছে চরম গনগনে মধ্যগগনের রবি। এবং খুব শিগ্গিরি তা পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে দেখছি না। টেস্ট ক্রিকেটের সেরা ইনিংস গুলো তুলে নিন। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ২৭০, ব্রায়ান লারার ১৫৩, বেন স্টোকসের ১৫৩, শচিন রমেশ টেন্ডুলকারের চেন্নাই শতক, বিরাট কোহলির অ্যাডিলেড বিক্রম, মাইকেল আথারটনের জোহানেসবার্গ মহাকাব্য বা বাবরেরই দেশজ হানিফ মোহম্মদের ট্রিপল সেঞ্চুরি।
কয়েকটি কমন ফ্যাক্টর পাবেনই। দারুণ বোলিং আক্রমণ, চরম অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা এবং ক্রমবর্দ্ধমান বহির্জাগতিক বাধা বিপত্তি যেমন খারাপ হতে থাকা পিচ, ক্লান্তি ইত্যাদি। বাবরের ইনিংসটায় সবকটি ছিল পুরোমাত্রায়। আসি এক এক করে।
প্যাট কামিন্স, মিশেল স্টার্ক, ন্যাথান লিঁও, মিশেল সোয়েপসন। এই চতুষ্টয়ের তিনজনই একেবারে যাকে ইংরেজিতে বলে, ‘সিজন্ড ক্যাম্পেনার’। সোয়েপসন সদ্য পদার্পন করেছেন টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায়। অনেকে বলেন, তিনি নাকি ওয়ার্নের মতো করে নিজের অ্যাকশন এবং বোলিং স্টাইল তৈরি করেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, ওই অ্যাকশনটাতেই খানিক ওয়ার্ন আছেন। তাও লুকিয়ে চুরিয়ে।
বাকিটা সবই ৩৪ প্রথম শ্রেণীর গড় সম্পন্ন গড়পড়তা স্বেপ্সন। ওয়ার্নেরও টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক কিছু হৈচৈ ফেলে দেবার মতো হয়নি। তবুও হলপ করে বলতে পারি, এতো ঘন ঘন লং হপ ও ফুলটস তিনি তখনও দিতেন না। কিন্তু বাকি তিনজন? এবং সাথে জ্যামিতির রাইডারের মতোই ভয়ঙ্কর ক্যামেরন গ্রিন। পরীক্ষায় বেশি মার্কসের আসে না। কিন্তু তবুও কাঁদিয়ে ছেড়ে দেয়। কামিন্স দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেস্ট বোলার।
বল রিভার্স করলে স্টার্ক মূর্তিমান যমদূত। আর চতুর্থ ও পঞ্চম দিনের পিচে ম্যাচ বাঁচানোর চাপ নিয়ে লায়নকে খেলা মানে ‘জাব তাক হ্যায় জান’ ছবির শাহরুখের মতো বিনা সুটে বোমা ডিফিউজ করতে যাওয়া। সমস্যাটা হলো গড়পড়তা ব্যাটার শাহরুখ নন। তা এতসব সামলেও বাবর যে নির্মল ছন্দে ব্যাট করেছেন, যেন ক্লিফটনের কোনো সেলিব্রিটির বাড়ির বাগানে আমন্ত্রণ মূলক ক্রিকেট খেলছেন।
এবার আসি অভ্যন্তরীণ চাপের কথায়। এমনিতেই প্রথম টেস্টে জাতীয় সড়কের মতো পিচ বানিয়ে পাকিস্তান যথেষ্ট চাপে। এতটাই, যে বাবরের শহর লাহোরে তৃতীয় টেস্টের জন্যে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে (পিসিবি) মেলবোর্নের কিউরেটর ভাড়া করতে হয়েছে। আর বাবার নিজেও কম চাপে ছিলেন না।
এমনিতেই পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হওয়া মানে বনগাঁ লোকালে সহযাত্রীকে ধরে ঝুলতে থাকা। একটু এদিক ওদিক মানেই, ব্যাস! তাঁর নিজের ব্যাটও টেস্ট ক্রিকেটে খানিক চুপচাপ ছিল গত বছর দুয়েক। চতুর্থ ইনিংসেও তাঁর রেকর্ড এতদিন ছিল বেশ নিম্নমানের। এছাড়া করাচিতে পাকিস্তানের এই অবস্থা হবে কেউ ভাবেইনি। করাচিতে পাকিস্তানের টেস্ট হারা মানে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে চেলসির হারা। দানিয়াল রাসুল দারুণ ভাবে তাঁর লেখায় করাচির মহিমা জানিয়েছেন।
‘অনবরত জঙ্গুলে বদলের মরুভূমিতে, করাচি পাকিস্তান ক্রিকেটের মরুদ্যান।’ তা সেই মরুদ্যানে বাবারের দল প্রায় হারতে বসেছে। নিজের অধিনায়কত্বর গদি একেবারে টলোমলো না হলেও হালকা ঝটকার গল্প রয়েছে। তা এতসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই ইনিংস খেলা মানে, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছাড়া কিয়েভের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো।
এবার আসি বহির্জাগতিক গল্পে। এমনিতে যদিও করাচির এই পিচে এমন কিছু ছিল না।
শেষ দিনেও দিব্যি আরামে ব্যাট করা গেল। কিন্তু টানা আড়াইদিন ওই গরমে খাটান দিয়ে, তারপর প্রথম ইনিংসে লণ্ডভণ্ড হয়ে, ম্যাচ বাঁচানোর চাপ নিয়ে খেলা চাড্ডিখানি কথা নয়। আমরা যারা একদিন আপিস ক্রিকেট খেলে পরের দিন গায়ের ব্যাথায় সময়ে আপিস পৌঁছতে পারিনা, নিশ্চয় সাক্ষ্য দেব বাবরের ব্যাপকতার। কিন্তু এতসবের পরেও, বাবরের মধ্যে এখনো কোহলি, স্মিথ বা রুটের সেরা সময়ের মতো জৌলুস আসেনি। তাই সাহস করে তাঁকে ‘এশিয়ার সেরা টেস্ট ব্যাটার’ বলে ফেলা গেলেও বিশ্বের সেরা টেস্ট ব্যাট হতে তাঁর এখনও বহু বহু ক্রোশ পারি দেয়া বাকি।