বেলা শেষের গান

কোথায় থামতে হবে বিষয়টা জানা খুবই জরুরি। রাস্তার লাল বাতি দেখেও তো গাড়ি চালানোটা সমীচীন নয়। আবার ধরুন এক হাড়ি রসগোল্লা আপনি এক বসায় শেষ করবেন ঠিক করলেন। তবে তা খেতে খেতে তেতো এক স্বাদ সারা মুখে ছড়িয়ে গেল। যে কোন ভাল কিছুর একটা শেষ প্রয়োজন। সময় মেনে একটা ইতি রেখা টেনে দেওয়া জরুরি।

তবে উপমাদেশের ক্রিকেটারদের যেন সে জ্ঞানটুকু নেই। না, মোটা দাগে ‘নেই’ বলে দেওয়া বিষয়টা বেশ দৃষ্টিকটু। জ্ঞানটুকু হয়ত আছে, তবে তাঁরা হয়ত কোন এক অজানা কারণে থেকে যান। সময় বাড়ান, খেলেন। আর শেষ বেলায় কেউ কেউ তো একরাশ সমালোচনার মুখে মাঠ থেকে বহুদূরে চলে যায়। লেবু বেশি কচলানে তেঁতো হয়।

এই যে যেমন বাংলাদেশের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কথাই বলা যাক। বয়সটা হয়েছে। সেই সাথে তাঁর রিফ্লেক্স কমেছে। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্যে এখন আর তেমন কার্যকরী নন। বরং তিনি দলে থাকা মানেই দলের মাঝে একটা নেতিবাচক একটা আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। তিনি বড্ড ধীরগতির রান সংগ্রাহক। একটা সময় তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটকে দু’হাত উজাড় করে দিয়েছেন। তবে সেই দিন হয়েছে গত। সেই বিষয়টাই যেন বুঝতে চাইছেন না মাহমুদউল্লাহ।

ফিটনেসটা যে নেই তাঁর একদমই। সে জন্য ছেড়ে দিলেন টেস্ট ক্রিকেট। তবে রঙিন পোশাকটা এখনই তুলে রাখতে চাইছেন না। আরেকটা উদাহরণ হতে পারেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সফল অধিনায়ক মাশরাফি। তিনি বাংলাদেশকে একটা সুদিনের পথে এনে দিয়েছেন। তাঁর সম্মানের ফুলের মালায় বিদায় নেওয়ার কথা ছিল মাঠ থেকে।

তবে তিনি আক্ষরিক অর্থে এখন পর্যন্ত বিদায় জানাননি ক্রিকেটর দুই ফরম্যাটকে বিদায় জানাননি। টেস্ট এবং ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি এখনও সাবেক ক্রিকেটার নন কাগজে-কলমে। জলঘোলা হয়েছে তাঁকে ঘিরে বহুবার। সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছে বারংবার। তবে এমনটাই কি প্রাপ্য ছিল তাঁর? সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এমন ঘটনা অবশ্য উপমহাদেশে নতুন নয়। এই যে ক্রিকেটের ঈশ্বর বলা হয় যাকে তিনিই তো নিজের ক্যারিয়ারটা টেনেছেন লম্বা সময় ধরে। শতকের শতক হাঁকানোর নেশায় বুদ শচীন টেন্ডুলকার নিজের ক্যারিয়াটাকে ঠিক যেন বানিয়ে ফেলেছিলেন রাবার। টেনে তিনি কেবল বড়ই করছিলেন। ঠিক সে সময়টায় তাঁকে নিয়ে হত সমালোচনা। তিনি রান করলেই নাকি ম্যাচ হারে ভারত।

মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে অবশ্য সমালোচনা হওয়ার সুযোগ খুব একটা ছিল না। তিনি অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন অনন্য, অতুলনীয়। তবে তিনি নিজের ক্যারিয়ারটা শুধুই লম্বা করেছেন। তিনিও চাইলে একটা সময় থেমে যেতে পারতেন। একটা আক্ষেপের সৃষ্টি করতে পারতেন, ‘ইস! আরেকটু দেখা গেল না ধোনির খেলা’।

পাকিস্তানের কিংবদন্তি জাভেদ মিয়াঁদাদও ঠিক মাঠ থেকে বিদায় জানাতে পারেননি ক্রিকেটকে। তিনি রীতিমত বুড়ো বয়সেও খেলেছেন পাকিস্তানের হয়ে। সত্তর দশকে অভিষেক হওয়া এক খেলোয়াড় একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও খেলেছেন। অবসর ভেঙে তিনি ফিরেছিলেন ক্রিকেটের। তবে লোকমুখে শোনা যায় তিনি সেটা করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে।

তবে বারবার অবসর ভেঙে আসবার অন্যতম উদাহরণ পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি। পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে আফ্রিদি সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন বলেই বিবেচিত হন। তিনি বহুবার ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ দিয়েও সেটাকে কমা বানিয়ে ফিরেছেন আবার।

উপমহাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে এমন ফিরে আসার দৃশ্য বেশ সচারচরই দেখা যায়। সবাই হয়ত ভাবতে পারেন ক্রিকেট প্রেম। না শুধু ক্রিকেট প্রেমের মায়ায় তাঁরা থেকে গেছেন সবুজ মাঠ আঁকড়ে ধরে, তা নয়। এখানে অর্থের ঝনঝনানির এক বিষয় রয়েছে। উপমহাদেশের মানুষেরা ক্রিকেট পাগল। আর সে সুবিধাটাই কাজে লাগান ক্রিকেটাররা, সে সাথে বিভিন্ন ব্র্যান্ড।

স্পন্সরশীপ ব্যাপারটা খেলোয়াড়দের ভীষণরকম প্রিয়। সেটাই হাতছাড়া করতে চাননা। তাছাড়া খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত অর্জনের একটা স্পৃহা বা ক্ষুধা থাকেই। সে কারণেই মূলত ক্রিকেট থেকে বিদায় নিতে খেলোয়াড়দের এত জলঘোলা করার প্রবণতা। এই প্রবণতা থেকে উপমহাদেশের কেবল লংকান ক্রিকেটাররাই নিজেদের দূরে রাখতে পেরেছে। তাঁরা বরং মাঠ থেকেই ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

বাকিদেরও ঠিক এই বোধদয় হওয়া প্রয়োজন। নিউজিল্যান্ডের রস টেইলর নিজেদের ঘরের মাঠে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন। নিজের মানুষদের সামনে নিজের একটা জীবনের ইতি টেনে নেওয়াটা নিশ্চয়ই বেশ স্বস্তিদায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link