তিনি যখন ব্যাট করতে নামতেন, মনে হত একটা দাবদাহের দিন শেষে, কোনো এক অলস লোক বৈকালিক ময়দানের হাওয়া খেতে চললেন। ব্যাট হাতে যখন স্টান্স নিতেন, মনে হত বিরিয়ানি, কাবাব ইত্যাদি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে, রোববার দুপুরে পিকনিক ক্রিকেটে ব্যাট করতে নেমেছেন কেবল।
কিন্তু কোনো এক মন্ত্র বলেই কিনা কে জানে, বোলারের হাত থেকে বল বেরিয়ে ব্যাটে লাগার মুহূর্তেই আলসেমোটা কোথাও উধাও হয়ে যেত। কখনো সেখান থেকে বেরোতো ফিরনি সম মিষ্টি কভার ড্রাইভ। কখনো মাটন রোগান জোশ সম মশলাদার পুল। আবার কখনো আখরোটের মত শক্ত ব্যাকফুট ডিফেন্স। তিনি ইনজামাম উল হক, ব্যাটিংয়ের অলস সৌন্দর্য্যের অপর নাম।
যে অলস ভঙ্গির কথা উপরে লিখলাম, সেরকম ভাবেই সারাজীবন ব্যাট করে গেছেন। সেভাবেই ৮৮৩০ রান করে ফেলেছেন। জাভেদ মিয়াঁদাদের তৎকালীন পাকিস্তান রেকর্ড ৮৮৩২ রানের চেয়ে মাত্র ২ রান কম। ৪ টেস্ট কম খেলে। মনে রাখতে হবে, ইনজির ক্যারিয়ারের বেশির ভাগটাই খেলা নিরপেক্ষ আম্পায়ারের জমানায়।
জাভেদের মত শাকুর রানার জমানায় তিনি খেলেননি। জীবনে দুবার তাঁকে এই অলসতার পর্দা ছিঁড়ে বেরোতে দেখেছি। একবার টরেন্টোয়, এক সমর্থককে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন অত্যন্ত সঙ্গত কারণে। আরেকবার ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে। কিন্তু আনোয়ারের বদান্যতায় রান-আউট হয়ে যান, এবং বেশিক্ষণ ‘তৎপর’ ইনজিকে টিভির পর্দায় দেখা যায়নি। দেখা গেলে বোধহয় সেদিন ভারতের কপালে দু:খ ছিল।
ক্রিকেট খেলার জন্য তথাকথিত উপযুক্ত চেহারা না হওয়া সত্ত্বেও তিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ১৬ বছর খেলেছেন। আর এমন কিছু ইনিংস ক্রিকেটমোদীকে উপহার দিয়েছেন, তা ভোলার নয়। করাচিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মুশতাক আহমেদকে নিয়ে জেতানো, লাহোরে কাঠ ফাটা রোদে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩২৯, এবং ১৯৯২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মার্টিন ক্রোর নিউজিল্যান্ডের অশ্বমেধের ঘোড়া একা হাতে থামিয়ে দেওয়া যার মধ্যে অন্যতম।
দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া, যে দেশে খেলেছেন সেখানেই সেঞ্চুরি করেছেন। কিন্তু কেন জানিনা, ক্রিকেটমোদীর মধ্যে ইনজামাম প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছেন খারাপ ইংরেজি বলার জন্য, কুৎসিত রান-আউট হবার চলমান ভেন্ডিং মেশিন হিসাবে এবং সর্বোপরি তাঁর স্থুল চেহারার জন্য। ইউটিউব খুললেই দেখা যাবে পানেসারের বলে হাস্যকর হিট-উইকেট, রান-আউটের কোলাজ এবং ‘ইনশাল্লাহ, বয়েস প্লেড ওয়েল।’ ইত্যাদি ভিডিও যত লোক দেখেছে, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে করা তাঁর টেস্ট সেঞ্চুরি গুলো তার সিকি ভাগ লোক দেখেনি।
রান-আউটের তালিকা খুললে দেখা যাবে, স্টিভ ও, অ্যালেন বর্ডার বা রাহুল দ্রাবিড় তাঁর চেয়ে এগিয়ে। স্থুলকায় তো ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং ও ছিলেন, কিন্তু তাঁকে তো মনে রাখা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সফল অধিনায়ক হিসাবে। হাস্যকর আউট কি ইনজামাম ছাড়া আর কেউ হননি? আসলে ইনজামাম বোধহয় এমনই।
অলস ভঙ্গিতে খেলে গেছেন। লোকে কি বললো না বললোর ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি নিজের ব্যাটিং করে গেছেন। এখনো তাঁকে নিয়ে বাকি বিশ্ব চরাচর কি ভাবলো তা বদলানোর কোনো তৎপরতা তাঁর নেই। কখনো বদলাতে চাননি, ফিটনেস নিয়ে তেমন বড় কোনো কাজ না করেও দিব্যি খেলে গেছেন, হয়ে উঠেছেন সর্ব কালের অন্যতম সেরাদের একজন।