প্রকৃত সেই লিটল মাস্টার

প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ঙ্করতম এক পরীক্ষার নাম ছিলেন। বোলারদের জন্য ছিলেন অসীম অপেক্ষার প্রতীক।

বারবাডোজে যখন ইতিহাস গড়া সেই ৩৩৭ রানের ইনিংস খেলছিলেন, তখন নাকি একটা ইংরেজী পত্রিকায় লেখা হয়েছিল-অনলি পুলিশ ক্যান রিমুভ দিস লিটল মাস্টার।

হ্যাঁ, তিনিই আদি ও অকৃত্রিম লিটল মাস্টার। তিনি সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। তিনি মোহাম্মদ হানিফ, দ্য গ্রেট।

১৯৩৪ সালের ২১ ডিসেম্বর গুজরাটের জুনাগড়ে জন্মগ্রহণ করেন হানিফ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে সপরিবারে চলে যান পাকিস্তানে। ১৯৫২ সালে পিতৃভূমি ভারতের বিপক্ষেই টেস্ট অভিষেক; পাকিস্তানেরই সেটা ছিল টেস্ট অভিষেক। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই মানুষটি হয়ে ওঠেন সে সময়ের ক্রিকেটের এক শ্রেষ্ঠতম ব্যাটসম্যান।

হানিফের মূল শক্তির ব্যাপারটা ছিল অবিশ্বাস্য রক্ষনাত্মক কৌশল। বলা হত পৃথিবীর যে কোনো উইকেটে, যে কোনো বোলারের বিপক্ষে অপরাজিত থাকার ক্ষমতা আছে এই ব্যাটসম্যানের। যার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন হানিফ ১৯৫৮ সালের সেই বারবাডোজ টেস্টে।

পাকিস্তান তখন ফলো অন করছিল। একদিকে রয় গিলক্রিস্টের নেতৃত্বে ত্রাস ফাস্ট বোলিং, আরেক দিকে আলফ ভ্যালেন্টাইনের বিষ মেশানো বোলিং। এর মুখে আরও একটা আত্মসমর্পন দেখতে চলেছিল বিশ্ব। সেখান থেকেই রেকর্ড এক প্রতিরোধ গড়ে তুললেন হানিফ।

ইনিংস শুরু করে ৩৩৭ রান করে যখন আউট হলেন, ততোক্ষণে ম্যাচ বেঁচে গেছে। আর হানিফ করে ফেলেছেন বিশ্ব রেকর্ড। কারণ এই ইনিংস খেলতে সময় নিয়েছিলেন ৯৭০ মিনিট। মানে, ১৬ ঘন্টা ১০ মিনিট ধরে ব্যাটিং করেছিলেন! আজও টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী সময় ধরে ব্যাটিং করার রেকর্ড হানিফ মোহাম্মদের।

আগে পরে ‘লিটল মাস্টার’ বলে দুনিয়ায় অনেককেই ডাক হয়েছে-স্যার ডন ব্র্যাডম্যান থেকে শচীন টেন্ডুলকার। কিন্তু এই ডাক নামটার সত্যিকারের সত্ত্বাধিকারী ছিলেন হানিফই।

৫৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৩,৯১৫ রান করেছেন ৪৩.৯৮ গড়ে। টেস্ট ক্যারিয়ারে উইকেট মাত্র একটি। তবে ছিলেন বৈচিত্রময় এক অলরাউন্ডার। তুখোড় এই ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দুই হাতেই বল করতে পারতেন। এমনকি উইকেট কিপিংও করেছেন একটা সময়ে।

ব্যাটিংয়ের শ্রেষ্ঠতম নির্দশন দেখিয়ে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে ভাওয়ালপুরের বিপক্ষে ৪৯৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন করাচির হানিফ। এই ইনিংস খেলার পথে স্যার ডনকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত প্রথম শ্রেনীর ইনিংসের মালিক হয়েছিলেন; ৫০০তম রানটা নিতে গিয়ে রান আউট হয়েছিলেন। ব্রায়ান লারা ১৯৯৪ সালে পার করে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এটাই প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে রেকর্ড ছিল।

শুধু ক্রিকেটার হানিফকে নিয়ে কথা বললে সেটা সম্পূর্ণ হবে না।

হানিফ মোহাম্মদ প্রয়ানকালে রেখে গেছেন বিশাল এক ক্রিকেটীয় পরিবার; পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ক্রিকেট পরিবার। এই মহীরূহ ব্যাটসম্যান হানিফরা ছিলেন ৫ ভাই: ওয়াজির মোহাম্মদ, রইস মোহাম্মদ, হানিফ মোহাম্মদ, মুশতাক মোহাম্মদ ও সাদিক মোহাম্মদ। ৫ ভাই-ই ক্রিকেট খেলতেন। এর মধ্যে ওয়াজির ২০ টেস্ট, মুশতাক ৫৭ টেস্ট, সাদিক ৪১ টেস্ট এবং হানিফ ৫৫ টেস্ট খেলেছেন!

ওয়াজিরের সঙ্গে বাকীদের একসাথে মাঠে নামা হয়নি। তবে মুশতাকের বিদায়ী টেস্টে; ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এই করাচি টেস্টে হানিফ, মুশতাক ও সাদিক একসঙ্গে মাঠে নেমেছিলেন। হানিফ ও সাদিক দু ইনিংসেই ওপেন করেছিলেন।

পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে অন্যতম মেধাবী বলে বিবেচিত রইস কখনো টেস্ট খেলেননি; তবে জাতীয় দলে একাধিক বার ডাক পেয়েছেন। ভাইয়েদের খেলা ম্যাচে দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে ফিল্ডিংও করেছেন!

এই পাঁচ ভাইয়েই বিস্ময়ের শেষ নয়। হানিফের ছেলে শোয়েব মোহাম্মদ আশি ও নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানের হয়ে ৪৫টি টেস্ট ও ৬৩টি ওয়ানডে খেলেছেন।

এই ঢাকার দর্শকরাও এক সময় হানিফের এই হার না মানা ব্যাটিং দেখেছেন। ১৯৫৫ সালে তখনকার ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান টেস্ট খেলেছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ড ৭০ রানে অল আউট হয়েছিল। জবাবে পাকিস্তান ৬ উইকেটে ১৯৫ রানে ইনিংস ঘোষনা করেছিল। ম্যাটিং উইকেটে সেই বোলিং স্বর্গ রাজ্যে দাড়িয়ে হানিফ মোহাম্মদ ২০৭ মিনিট ব্যাট করে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।

তবে ঢাকায় হানিফের সেরা কীর্তি এটা নয়। এখানে তিনি জোড়া সেঞ্চুরিও করেছেন। ১৯৬২ সালে এই ঢাকায় ডেক্সটারের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ১১১ ও ১০৪ রান করেছিলেন। রকিবুল হাসানের মত বহু কিশোর ব্যাটসম্যানের তখন রাতারাতি আইডল হয়ে গিয়েছিলেন হানিফ।

বর্ণময় এই মানুষটি ১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচিতে নিজের শেষ টেস্ট খেলেন। এরপর ১৯৭৫-৭৬ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে গেছেন। ক্রিকেট ছাড়ার পর ‘দ্য ক্রিকেটার’ পাকিস্তান নামে একটি ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটা দুই দশক ধরে সম্পাদনাও করেছেন। এ ছাড়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) দলের টিম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন।

১৯৬৮ সালে তিনি উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আইসিসি হল অব ফেম চালু করলে শুরুতেই সেখানে অর্ন্তভূক্ত হন।

খেলা ছাড়ার পর আধুনিক ক্রিকেট নিয়ে কালেভদ্রে কথা বলতেন। তবে অত্যন্ত পছন্দ করতেন শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিং। দু জনের কয়েকবার সাক্ষাতও হয়েছে। হানিফ নিজে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও টেন্ডুলকারের খেলা দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সব সময় টেন্ডুলকারকে সর্বকালের সেরা বলে মনে করতেন।

এই সব কিছুতেই অতীত করে ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট দুনিয়া ছেড়ে যান এই ক্রিকেট কিংবদন্তী। ৮১ বছর বয়সে করাচির আগা খান হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই পাকিস্তানী কিংবদন্তী।

২০১৩ সাল থেকে থেকে ভুগছিলেন ফুসফুস ক্যান্সারে। হাসপাতালেই চিকিৎসা চলছিল। সেদিন দুপুরে প্রথম হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে, খবর রটে যায় যে, হানিফ মোহাম্মদ মারা গেছেন। তখন অবশ্য পূত্র শোয়েব মোহাম্মদ জানিয়েছিলেন, এই গ্রেটকে নিবিঢ় পর্যবেক্ষন কেন্দ্রে নেওয়া হলেও জীবিত আছেন তিনি। তবে সেদিনই সন্ধ্যায় আশঙ্কা সত্যি করে চলে যান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link