মোহাম্মদ রফিকের ডেলিভারিটা ফাইন লেগে ঠেলে দিয়ে সিংগেলের জন্য ছুট। পার্টনার মোহাম্মদ কাইফের সাথে ভুল বোঝাবুঝি। ততক্ষণে বিদায় ঘন্টা বেজেই গেছে তাঁর। পপিং ক্রিজে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ফাইন লেগ থেকে তাপস বৈশ্যর থ্রো-তে পাইলটের দারুণ রান আউট। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হলো গোল্ডেন ডাক দিয়ে। দেশের রঙিন জার্সি গায়ে চাপিয়ে শুরুটা হলো মলিন।
শেষবার দেশের জার্সি চাপিয়ে মাঠে নেমেছেন গত বছর। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে। সেমিফাইনালে। ব্রিটিশ মুলুকের ম্যানচেস্টারে।
তার শরীর বরাবর লোকি ফার্গুসনের ‘রুম’ না দেওয়া এক বাউন্সার। কোনোরকমে শট খেলে পড়িমরি করে দৌড়। দুই রান নিতেই হবে। বল ততক্ষণে স্কয়ার লেগে, আস্তে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ডিপে। তখন দুই রানের চিন্তায় ছুটছেন তিনি। সাড়া দিলেন ভুবনেশ্বর। তার আগেই সাড়া দিল ডিপ স্কয়ার লেগে থাকা মার্টিন গাপটিলের নার্ভ, হাত, পা। ছুটে এসে বল পিক আপ। করলেন দারুণ এক থ্রো।
সেই থ্রোতে ডিরেক্ট হিট! জ্বলে উঠলো এলইডি স্টাম্প। প্রযুক্তির আশীর্বাদের এলইডি জ্বলে উঠলেও
নিভে যায় ভারতের শেষ আলোকবর্তিকা। সেই আলো অদৃশ্য হলেও অন্ধকারটা বেশ ভালোমতোই জাকিয়ে বসে। ড্রেসিংরুমের কাঁচের দেয়ালে মাথা ঠেসে ধরে হতাশাটা ঢাকতে চেয়েও পারেননি রোহিত শর্মা।
গাপটিলের অগ্রজ, ইয়ান স্মিথ গর্জে উঠলেন ‘ডিরেক্ট হিট’ বলে। পাশে বসা সাবেক ভারত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি মাইক্রোফোন বার কয়েক হাতে নিয়েও কী বলবেন, খুঁজে পাচ্ছিলেন না যেন।
স্রেফ এক ইঞ্চির মার্জিন। এক ইঞ্চির মার্জিনে, ছোট্ট ব্যবধানে লেখা হয়ে গেছিল বিশাল এক যাত্রার ইতিকথা। থমকে গেছিল ভারতের বিশ্বকাপ স্বপ্ন৷ সেই এক ইঞ্চির ব্যবধান, দুরত্বটা ঘুচে গেলে চিত্রনাট্য বদলে যেত হয়তো আমূল। ভারতেরও, তারও।
রান আউটে শুরু, রান আউটে শেষ। দুই রান আউটেই চিঠির ‘প্রিয়’ আর ‘ইতি’। প্রকৃতির কী খেয়াল। কতবার রান আউট করেছেন, গড়ে দিয়েছেন ম্যাচের ভাগ্য। বদলে ফেলেছেন ম্যাচের গতিপথ। ঘুরিয়ে দিয়েছেন মোড়। কখনো ইঞ্চিখানেক, কখনো বিঘতখানেক দুরত্বে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে রেখে। অথচ সেই রান আউটেই বদলে গেল ক্রিকেটার ধোনির গল্পটা। থমকে গেল সেই ম্যানচেস্টারে।
এক চক্র পূরণ। যেন নিপুন হাতে গাঁথা কোনো মালা। সেই মালার প্রথম ফুলটা ছিল মলিন, শেষটা ছিল বিষাদে পূর্ণ, কিন্তু সৌরভ ছড়ানো। আর মাঝে? মহেন্দ্র সিং ধোনির গোটা ক্যারিয়ারটা। আছে হার্ড হিটার, ফিনিশার, ক্যাপ্টেন কুল, হেলিকপ্টার শট নামের বাহারি ফুল।
রান, সংখ্যা, রেকর্ডস, স্ট্যাট ওসব এক্সপার্টদের জিনিস। আমার লেখায় এসব খুঁজলে হতাশই হবেন পাঠক।
২০০৫। পাকিস্তান ট্যুর। ধোনির তখন স্ট্রেইট করা ব্রাউন শেডে লম্বা চুল, ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। ওয়ানডে সিরিজের এক ম্যাচে ৭২* রানের ইনিংস খেললেন। যুবরাজের সাথে ম্যাচ জেতানো পার্টনারশিপ। জুটলো ম্যান অফ দ্য ম্যাচ এওয়ার্ড। হাতে তোলে দেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পারভেজ মোশাররফ। ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে ধোনিকে বলেন এই চুলটা না কাটতে। কত আর বয়স তখন? ২৩-২৪? এই বয়সে লম্বা চুলের বাতিকটা বোধহয় সব ছেলেরই থাকে। ধোনির ট্রেডমার্ক ই তো হয়ে গেছিল সেই ঘাড় অবধি লম্বা চুল।
পুরনো কথা বললে ফুরাবে না। এত বর্ণিল একটা চরিত্র ক্রিকেটের। শব্দে আটকে রাখতে পারলে তো হতোই। যা যা করেছেন, তাতে শব্দ, বিশেষণে তাকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়।
ব্যাটিং অ্যাবিলিটি, উইকেট কিপিং, পাওয়ার হিটিং, ফিনিশিংয়ের সাথে সবচেয়ে বেশি কথা হয় তার ক্ষুরধার, ঠান্ডা মস্তিষ্কের ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে, সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে।
ধোনিকে বলা হয় ক্যাপ্টেন কুল। আসলেই কি কুল? নার্ভটা তার শক্ত। বোলার, ফিল্ডার ভুল করলে রিয়েক্ট করতে দেখা যায় না তাকে। তবে সুরেশ রায়না বলেছিলেন ধোনির ধমক, ঝাড়ি, রাগের কথা। এমনিতে শান্ত থাকলেও, ভুল করলে ওভার ব্রেকেই নাকি চলতো তুমুল ধমক আর থ্রেট! লাইক ‘সুধার যা তু’!
গাট ফিলিং তো বটেই, গেম রিডিং অ্যাবিলিটি তার দুর্দান্ত। কতশত উদাহরণ জমেছে এমন। একটা ঘটনা বলি, এখনো গেঁথে আছে মাথায়। গত এশিয়া কাপে সাকিব মারছিলেন জাদেজাকে। সুইপ করে দুটো চার মারার পর ফাইন লেগ থেকে স্কয়ার লেগে ধাওয়ানকে টেনে আনেন যেন কোন ফাঁকে। সাকিব খুব সম্ভবত খেয়াল করেননি চেঞ্জটা। একই রিজিওন দিয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন ধাওয়ানের হাতে। ধোনি তখন ‘অধিনায়ক’ নন।
বয়স বাড়ে, দিন ফুরোয়। এক সময়ের টগবগে ঘোড়াটার হাড়েও মরিচা পড়ে। সারাজীবন কীভাবে সবকিছু ফেলে রেখে ছুটেছে সবাই ভুলে যায়। যখনই একটু হোচট খায়, ফেলে রাখে আস্তাবলের এক কোণে। এটাই বোধহয় নিয়ম। ভারতকে যা যা জেতানো যায় জিতিয়েছেন। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের পর ভারতের ট্রফি ক্যাবিনেটে যা যা জমেছে, সিংহভাগেই ধোনির ছোঁয়া।
এক ইন্টার্ভিউতে ধোনিকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করেছিলেন, সিরিজ বা টুর্নামেন্ট জেতার পর কাপটা হাতে নিয়েই কেন সতীর্থদের দিয়ে দেন? যদ্দুর মনে পড়ে উত্তরে ধোনি বলেন, ‘অধিনায়ক বলে ট্রফিটা নিজের করে নেয়ার এখতিয়ার আমার নেই। দলের বাকি যারা আছে, তারাও ফিল করুক, আমিও দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’
সবকিছু থামে। সবকিছুরই শেষ আছে। মাসান ছবিতে ভিকি কৌশলের দুঃখটাও কমেছিল। কিছু শেষ অফিশিয়ালি হয়, মিউচুয়ালি হয়। কিছু হয় অনাড়ম্বরে, আড়ালে আবডালে। স্পটলাইটের বাইরে থেকে। ধোনিও সরে গেছেন সেভাবেই। চুপচাপ, নির্লিপ্তভাবে। যেমনটা থাকতেন মাঠে। নিজের সবটুকু স্মৃতির আর্কাইভে তুলে রেখে।
ভেবে দেখুন তো, আমার-আপনার জীবনে ধোনির মতো কিছু মানুষ আছে কিনা? কিংবা অন্য কারো জীবনে আপনি ধোনির মতোন কিনা? সকল সুখস্মৃতি, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, আগলে রাখা সবই করেছেন কারো জন্য। কিন্তু বেলাশেষে আপনি সরে গেছেন তার সার্কেল থেকে বা সে সরে গেছে আপনার জীবন থেকে। নীরবে, নিভৃতে, আড়ালে। একটু চোখ ফেরালেই পেয়ে যাবেন তাকে, কিংবা আপনাকে খুঁজে পাবে কেউ।
টানা ১৬ বছর উড়েছে হেলিকপ্টার। পাড়ি দিয়েছে কত বাহারি মেঘে ভরা আকাশ। লেগেছে বজ্রের আঘাত, চমকে উঠেছে সব বিজলির ঝলকানিতে। তবুও থামেনি তখন।
এখন শান্ত, শুভ্র আকাশ পেরিয়ে এসে হেলিপ্যাডে থেমেছে সেই হেলিকপ্টার। যে হেলিকপ্টারে চড়ে ২০১১ সালে জমজমাট হয়েছিল মুম্বাই।, এর আগে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি, পরে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। টেস্টে টপার। এশিয়া কাপ।
আন্তর্জাতিক উঠানে উড়বে না আর ধোনির হেলিকপ্টার। যে কদিন বাকি আছে, সে কটাদিন হেলিকপ্টার উড়ুক তার নিজের রুটে, নিজের ওয়েতে। দ্য মাহি ওয়ে!