তিনটা যুগের অধরা সেই সোনালী শিরোপাটা এবার যাচ্ছে আলবি সেলেস্তাদের দেশে। ২০১৪ সালের স্বপ্নে বিভোর দলটার সবকিছু চুরমার করে দিয়েছিল মারিও গোৎজে নামক এক ক্ষণস্থায়ী তারা। এরপর মাঝের আরও একটি বিশ্বকাপের হতাশা শেষে আনন্দের অশ্রু ঝড়লো কাতারের মরুভূমিতে। সে নোনা জ্বলে হাজার খানেক বটবৃক্ষ জন্মাবে। যার প্রতিটি পাতায় বিশাল সব কাব্য লেখা হবে। তবে সে বটবৃক্ষের শিকড়ে একটি নাম লেখা রবে। কেউ তা দেখবে না, কেউ তা জানবে না, কেউ সেই নাম নিয়ে কথা বলবে না। নামটি আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনির।
স্বপ্ন তো সবাই দেখে, শেষ বেলায় আবার লিওনেল মেসির পূর্ণতার গল্পে বারবার আঘাত হানা ২৩ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পেও নিশ্চয়ই স্বপ্নই দেখছিলেন আরেকটিবার বিশ্বজয়ের। তবে গল্পটা লিখে ফেলা বহু আগেই। ওই যে সেদিন, সৌদি যেদিন বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনটা ঘটালো। সেটার মাত্রা অবশ্য এখন আরও অনেক বড়। সেই একটি হার স্কালোনিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যায়। তাঁর দলটা চ্যাম্পিয়ন হবার দল। তবে রয়েছে তাদের কিছু ভুল। ব্যাস, এই বিশ্বকাপ জয়ের জন্যে খানিকটা ধন্যবাদ নিশ্চয়ই সৌদি আরব প্রাপ্য।
সৌদি আরব তাদের প্রাপ্যটুকু পাবে কি পাবে না, এটা পরের আলাপ। তবে আড়ালে যেতে দেওয়া যাবে না স্কালোনির কৃতীত্ব। লিওনেল মেসি কিংবা ডি মারিয়া অথবা জুলিয়ান আলভারেজদের নিয়ে যেমন উপন্যাস হবে তেমনি স্কালোনিও একটি রোমাঞ্চকর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। ২০১৮ সালে হোর্হে সাম্পাওলির আর্জেন্টিনা দল যখন হেরেছিল এই ফ্রান্সের কাছে, তখন সামনে থেকে দলটির ভুল দেখেছিলেন স্কালোনি। ছোট্ট কোন নোটবুকে সবকিছু কম্পিত হস্তে লিখে রেখে ছিলেন। সে সময় তিনি ছিলেন সাম্পাওলির সহকারী।
এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রধান, তারপর ফেডারেশনের আস্থা অর্জন করে বস বনে গেলেন স্কালোনি। পরের গল্পটায় কম চড়াই-উৎরাই পেরুতে হয়নি তাঁকে।দলটাকে সাজাতে হয়েছে, লিওনেল মেসিকে বোঝাতে হয়েছে। দলটাকে এক সুতোয় গাঁথতে হয়েছে। সেটার ফলাফলটাও তিনি ক্রমশ দিতে শুরু করেন। ২০১৯ সালে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার পর, তিনি ভগ্ন হৃদয়ের মেসিকে বোঝালেন। ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিলেন। আর স্কালোনি ছক কষতে বসলেন ঠিক কি করে মেসির কাঁধ থেকে বোঝা নামানো যায়।
সে পরিকল্পনা করতে করতে স্কালোনি দল নিয়ে হাজির ২০২১ কোপা আমেরিকার মঞ্চে। সেখানেও তাঁর রণকৌশলে কুপকাত চিরপ্রতিদ্বন্দী ব্রাজিল। বিখ্যাত মারাকানা দূর্গ জয় করে লিওনেল মেসির অপূর্ণতার তালিকা থেকে মুছে যায় আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের আক্ষেপ। তবে মনে মনে স্কালোনি হয়ত বলেছিলেন, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত’। তিনি আরও বড় স্বপ্ন বুনতে শুরু করলেন। একটা ইউনিট গড়ে তুললেন। পুরো আর্জেন্টিনা দলটা হয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য।
বিশ্বকাপে পদার্পণের আগে আরও একটি অর্জন নিজেদের করে নেয় এই আর্জেন্টিনা দলটি। ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিসিমা জেতে আলবি সেলেস্তারা। তবে বাজপাখির মতই লক্ষ্য স্থির স্কালোনির। সেটা কেবল ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। খেলোয়াড় হিসেবে সেটার ধারেকাছেও তিনি যেতে পারেননি। তবে একজন পথপ্রদর্শক হয়ে তিনি ছুঁয়ে দেখলেন ছয় কিলোর সেই স্বর্ণালী ট্রফিটা। তবে পথটা একেবারেই ছিল না মসৃণ। শুরুতেই হোচট। পুচকে সৌদি আরব হারিয়ে দিয়ে সব হিসেব-নিকেশ ওলোট-পালোট করে দেয়। ঠিক ওলোট-পালট নয়। সঠিক পথটা বাতলে দেয়।
ব্যাস! এরপর থেকেই শুরু স্কালোনির ম্যাজিক। মাঠে মেসির ম্যাজিক। আর ড্রয়িং বোর্ডে স্কালোনির। গ্রুপ পর্ব থেকে প্রতিটা ম্যাচই ছিল নকআউট ম্যাচ। আর প্রতিটা ম্যাচেই স্কালোনির প্রসংশা করেছে পুরো বিশ্ব। তিনি সাহস দেখিয়েছেন। প্রতিপক্ষকের উপর পড়াশোনা করে ভিন্ন-ভিন্ন ফরমেশন আর ট্যাকটিস সাজিয়েছেন। বিশ্বকাপের মত মঞ্চে দলকে সে মোতাবেক খেলিয়েছেন। সাফল্য তো সেখানেই। জাতীয় দলে খেলোয়াড়দের একত্রে কাঁটানোর মত সময় বেশ অল্প। তবুও এই অল্প সময়ে দলকে ভিন্ন সব কৌশলে খেলানোর পরও সফলতা পেয়েছেন স্কালোনি।
একেরপর এক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে, তাঁর শীর্ষ্যরা ফিরেছে বিজয়ীর বেশে। সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাটা নিয়েছে নেদারল্যান্ডস ও ফাইনালের দিনে ফ্রান্স। তবুও কথায় আছে, ‘ফরচুর ফেভার্স দ্য ব্রেভস’। নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে সাহসী কোচ ছিলেন স্কালোনি। আর তাঁর প্রতিদানটা ভাগ্য তাঁকে দিয়েছে দু’হাত ভরে। এই দলটাকে রীতিমত কোলে-পিঠে করে মানুষ করে তিনি বানিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! নিশ্চয়ই তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে গর্বিত অভিভাবক।
হুগো লরিসকে বোকা বানিয়ে যখন গনসালো মন্টিয়েল বলটি জালে জড়ালেন, তখন স্কালোনি ডাগআউটে অঝোরে কাঁদলেন। প্রতিটি অশ্রু ফোঁটা জানান দিচ্ছিল এই আনন্দের পেছনে ঠিক কতটা শ্রম লেগেছে, ঠিক কতগুলো রাত নির্ঘুম কেটেছে, ঠিক কতখানি পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ব্যক্তিগত অর্জনের একটি বাদে সব জিতেছে তাঁর শীর্ষ্যরা। ফিফা এখানটায় বড় অন্যায় করে। এমন সাহসী আর অদম্য শক্তির স্কালোনিদের কোন স্বীকৃতি দেয় না। তবুও দিনশেষে বিজয়ীর বেশে মরুর বুকে একটা অশ্রুজলে বেড়ে ওঠা মহাকাব্যিক বটবৃক্ষের শেকড় হয়ে রইবেন লিওনেল সেবাস্তিয়ান স্কালোনি।