রেকর্ড ভেঙে রেকর্ড গড়ার গল্প

‘রেকর্ড গড়াই হয় ভাঙার জন্য’ - সে কথাকে পুঁজি করে জোহানেসবার্গে সেদিন ইতিহাস রচনা করেছিল হার্শেল গিবস-স্মিথরা। অজিদের করা পাহাড়সম রান টপকে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা রান তাড়ার রেকর্ডে নাম লেখায় প্রোটিয়ারা। সেই রেকর্ডগড়া ম্যাচের স্মৃতির পাতায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক, গিবস-পন্টিংদের চোখে চোখে রেখে লড়াইয়ের দিনে প্রোটিয়াদের শেষ হাসির গল্পটা আরেকবার শোনা যাক।

১২ মার্চ, ২০০৬ ক্রিকেট পাড়ায় এই দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে বিশ্ব দেখেছিল এক ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়া ম্যাচ ৷ সিরিজে ২-২ এ সমতায় ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। শেষ ওয়ানডেতে যে জিতবে সেই ঘরে তুলবে ট্রফি। পঞ্চম ও শেষ ওয়ানডেতে জোহানেসবার্গে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং।

প্রথমে ব্যাট করে রিকি পন্টিংয়ের দেড়শো আর গিলক্রিস্ট-হাসির ফিফটিতে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে অজিরা দাঁড় করায় ৪৩৪ রানের পাহাড়সম স্কোর! এই রেকর্ড তাড়া করা দূর প্রোটিয়ারা কত রানে হারবে তার হিসাব কষতেই কষতেই হয়তো মগ্ন ছিলেন ক্রিকেট ভক্ত থেকে ক্রিকেট বিশ্লেষকরা।

‘রেকর্ড গড়াই হয় ভাঙার জন্য’ – সে কথাকে পুঁজি করে জোহানেসবার্গে সেদিন ইতিহাস রচনা করেছিল হার্শেল গিবস-স্মিথরা। অজিদের করা পাহাড়সম রান টপকে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা রান তাড়ার রেকর্ডে নাম লেখায় প্রোটিয়ারা। সেই রেকর্ডগড়া ম্যাচের স্মৃতির পাতায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক, গিবস-পন্টিংদের চোখে চোখে রেখে লড়াইয়ের দিনে প্রোটিয়াদের শেষ হাসির গল্পটা আরেকবার শোনা যাক।

প্রথমে ব্যাট করতে নেমে সায়মন ক্যাটিচ ও এডাম গিলক্রিস্টের দাপুটে ব্যাটিংয়ে ওপেনিং জুটিতেই আসে ৯৭ রান। শুরু থেকেই দুই ওপেনার ৬+ গড়ে রান তুলতে থাকে। ৯৭ রানে সাইমন ক্যাটিচ ব্যক্তিগত ৭৯ রানে মাখায়া এনটিনির বলে ফেরত গেলে ক্রিজে আসেন রিকি পন্টিং।

দ্বিতীয় উইকেটে গিলক্রিস্টকে সঙ্গে নিয়ে ২২ গজে ঝড় তুলেন বর্তমান এই অজি লিজেন্ড। রানের ক্ষুদায় ২২ গজে একপ্রকার তান্ডব চালান পন্টিং। দ্বিতীয় উইকেটে ১১৯ রানের জুটি গড়েন দু’জনে! এরপর ব্যক্তিগত ৪৫ বলে ৫৫ রানে গিলক্রিস্ট ফিরলে দলীয় স্কোর দাঁড়ায় ৩০.৩ ওভারে ২ উইকেটে ২১৬ রান।

প্রোটিয়াদের বোলিংয়ের ধার যেন এ পর্যন্তই শেষ। তৃতীয় উইকেটে পন্টিংয়ের সাথে জুটি গড়তে আসেন মাইকেল হাসি। হাতে ১১৭ বল আর ৮ উইকেট, আফ্রিকান বোলারদের উপর দিয়ে তাণ্ডব চালালেন পন্টিং-হাসি! তৃতীয় উইকেটে পন্টিং-হাসির করা ৯৪ বলে ১৪৮ রানের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে বিধ্বস্ত পুরো প্রোটিয়া শিবির। এ যেন এক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখছে দর্শকরা। পন্টিং তুলে নেন দেড়শো আর অপরদিকে মাইক হাসি তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি!

দলীয় ৪৬.১ ওভারে ৩৭৪ রানে চতুর্থ উইকেটের পতন হয়, মাইক হাসি ফেরেন ৫১ বলে ৮১ রানের ঝড়ো ইনিংসের পর! তখনও ইনিংসের ২৩ বল বাকি, তবু ঝড় থামাননি পন্টিং-সায়মন্ডসরা। পন্টিং-সায়মন্ডসের বলে চারশো’র কোটা পেরোয় অজিরা। দলীয় ৪০৭ রানে ব্যক্তিগত ১০৫ বলে ১৬৪ রানে বিদায় নেন রিকি পন্টিং। তবে শেষে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের ১৩ বলে ২৭ রানের ক্যামিওতে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে অজিরা সংগ্রহ করে ৪ উইকেটে ৪৩৪ রানের পাহাড়।

উত্তপ্ত জোহানেসবার্গ, উত্তপ্ত প্রোটিয়া শিবির। অজিদের সিরিজ জয় অনেকটাই নিশ্চিত তখন! সেদিন কেউ হয়তো চিন্তা করে দ্বিতীয় ইনিংসে হার্শেল গিবস-স্মিথরা গড়তে যাচ্ছেন ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা রেকর্ড। ড্রেসিং রুমে কোচ-অধিনায়করা কি প্ল্যান করছিলো তা বাইরে থেকে জানার সাধ্যি ছিল না কারোই, শুধু হিসাব-নিকাশ প্রোটিয়ারা কত রানে হারবে!

দ্বিতীয় ইনিংসে প্রোটিয়াদের হয়ে ব্যাট করতে এলেন অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ ও ডিপেনার। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ডিপেনারকে তুলে নেন ব্রেট লি! মাত্র তিন রানেই এক উইকেট হারিয়ে এ যেন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’। দ্বিতীয় উইকেটে ক্রিজে আসলেন হার্শেল গিবস। শুরু থেকে অজি বোলারদের উপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকেন দু’জনেই। দ্বিতীয় উইকেটে স্মিথ-গিবসের ১৮৭ রানের ঝড়ো জুটি জোহানেসবার্গে প্রাণ ফেরায় প্রোটিয়া সমর্থকদের।

তখনও অজিদের দেওয়া টার্গেট দুর্ভেদ্য মনে হচ্ছিল কারণ দলীয় ১৯০ রানে ব্যক্তিগত ৫৫ বলে ৯০ রান করে আউট হয়ে ফেরত যান স্মিথ। মাত্র ২২.১ ওভারেই ১৯০ রান স্কোরবোর্ডে তুলেন স্মিথ-গিবসরা। ৩য় উইকেট গিবসের সাথে জুটি গড়েন এবি ডি ভিলিয়ার্স।

তবে ডিভিলিয়ার্স যেন শুধুই দর্শক কারণ একা হাতেই অজি বোলারদের নাস্তানাবুদ করছিলেন গিবস। তৃতীয় উইকেট গিবস-ডিভিলিয়ার্সের করা ৯৪ রানের জুটির মধ্যে ডিভিলিয়ার্স করেন মাত্র ১৪ রান! বাকি কাজটা একা হাতেই সেরেছেন গিবস। দুর্দান্ত ব্যাটিং করে গিবস তুলে নেন দেড়শো!

এরপরই হঠাৎ অজিদের ম্যাচে ফেরা, মাত্র ৪২ রানের মাথায় অজিদের নেই পাঁচ উইকেট! দলীয় ৩২৭ রান করতেই আউট ডিভিলিয়ার্স, গিবস ও ক্যালিসরা। তখনো প্রোটিয়াদের প্রয়োজন ৭৪ বলে ১০৮ রান! বার্ক বাউচার একপ্রান্ত আগলে রেখে খেলতে থাকেন, অপরপ্রান্তে জাস্টিন কেম্প কিছুটা সময় কাটালেও তিনি ফেরেন ব্যক্তিগত মাত্র ১৩ রান।

৩৫৫ রানে ৬ উইকেট পড়লে প্রোটিয়া শিবিরে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দেয়! ৪৭ বলে দরকার ৮০ রান, সব আশা ভরসা তখন বাউচারের হাতেই। কিন্তু দুঃসময়ে দলের দায়িত্বশীল কান্ডারি হিসেবে ব্যাট হাতে ঝড় তুললেন ভ্যান ডার ওয়েথ! বাউচার একপ্রান্ত আগলে রেখে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওয়েথের ১৮ বলে ৩৫ রানের ঝড়ে আবারো জয়ের আশা জাগায় প্রোটিয়ারা। তবে দলীয় ৩৯৯ রানে ওয়েথ আউট হলে শেষ ২১ বলে দরকার লাগে ৩৫ রান, হাতে তখন মাত্র তিন উইকেট।

বাউচারের উইকেট টা নিতে পারলেই যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে অজিরা! কিন্তু প্রোটিয়া টেইলএন্ডারদের দক্ষতায় এ যাত্রায় শেষ রক্ষা হয়নি অজিদের। রজার টেলেমাচুসের ৬ বলে ১২ রানে ম্যাচ তখন জমে ক্ষীর! ম্যাচে তখন টান টান উত্তেজনা! ১১ বলে দরকার আর মাত্র ১২ রান। ম্যাচ তখন আফ্রিকার হাতেই, তবে বিপত্তি বাঁধল রজার উইকেটে! ৪২৩ রানে রজারের বিদায় অষ্টম উইকেটের পতন ঘটলে কিছুটা চিন্তার ভাজ পড়ে প্রোটিয়াদের কপালে। তবে আশার কথা বাউচার তখনো আছেন ক্রিজে। ৪৯ ওভার শেষে প্রোটিয়াদের সংগ্রহ ৮ উইকেটে ৪২৮ রান।

শেষ ওভার দরকার ৭ রান হাতে ২ উইকেট। যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে জোহানেসবার্গে! চাঁপা উত্তেজনায় স্তব্ধ ক্রিকেট দুনিয়া। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ম্যাচের শেষ হাসিটা কে হাসবে তার জন্য বাকি আর মাত্র ৬ বল! স্ট্রাইকে বাউচার আর বল হাতে ব্রেট লি। প্রথম বলেই সিঙ্গেল নিয়ে বাউচার গেলেন নন স্ট্রাইক প্রান্তে, অজি শিবিরে যেন স্বস্তির নি:শ্বাস। পাঁচ বলে দরকার ছয় রান! তবে অজিদের আশায় পানি ঢেলে শেষ ওভারে ২য় বলেই চার মেরে দেন অ্যান্ড্রু হল! প্রোটিয়া শিবিরে উল্লাস আর জয়ের হাতছানি। অজি শিবিরে হতাশা আর গ্লানি! শেষ ৪ বলে দরকার মাত্র ২ রান।

তবে উত্তেজনার শেষ এখানেই নয়, রুপকথার গল্পের মতো এই ম্যাচ টার্ন করেছে বাঁকে বাঁকে! পরের বলেই আউট এন্ড্র হল। অজি শিবিরে আবারো হাসি, প্রোটিয়া শিবিরে হতাশা কারণ শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে স্ট্রাইকে থাকবেন এনটিনি। শেষ তিন বলে আফ্রিকার দরকার ২ রান আর অজিদের প্রয়োজন এক উইকেট!

পরের বলেই সিঙ্গেল নিয়ে এনটিনি রান সমতায় আনেন, স্ট্রাইকে বাউচার আর ম্যাচ তখন প্রোটিয়াদের হাতেই। আফ্রিকার জিততে ২ বলে ১ রান অজিদের ড্র করতে দরকার ১ উইকেট। না উত্তেজনার শেষ পরের বলেই, ব্রেট লি’কে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে হাফ সেঞ্চুরির সাথে সাথে প্রোটিয়াদের ১ উইকেটের ঐতিহাসিক জয় এনে দিলেন মার্ক বাউচার।

এখন পর্যন্ত সেই রান তাড়ার রেকর্ডটি ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ম্যাচ হিসেবেই তালিকায় আছে। সেদিন জোহানেসবার্গে দর্শকরা সাক্ষী হয়েছিল ৮৬৮ রানের! যা কিনা যেকোনো ওয়ানডে ম্যাচের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান। ম্যান অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কারটা পান ১৭৫ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংস খেলা হার্শেল গিবস। সেদিন জোহানেসবার্গে গিবস-স্মিথদের সামনে অসহায়ত্ব বরণ করেছিল অজিরা। এই ম্যাচ ক্রিকেট ইতিহাসে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে স্মৃতির পাতায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...