উরোপের ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের আসর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহের কোন অন্ত নেই। রাত জেগে দারুণ লড়াই দেখতে মুখিয়ে থাকেন খেলাটিকে ভালবাসা মানুষজন। প্রতিটা আসরে যেমন নতুনত্ব আসে ঠিক তেমনি জন্ম হয় নতুন নতুন তারকার। খেলোয়াড়দের মতো ক্লাবের লড়াই ছাপিয়ে যায় দেশের লড়াইকেও।
সর্বশেষ শিরোপা জেতা ইংলিশ ক্লাব চেলসির মতো বিভিন্ন দেশের ক্লাবগুলো মুখিয়ে থাকে শিরোপা জেতার জন্য। এবার লিওনেল মেসি দলবদল করে বার্সেলোনা থেকে পিএসজিতে আসার পর দেশ হিসেবে নতুন করে যোগ হয়েছে ফ্রান্সের নাম। পাশাপাশি জুভেন্টাস ছেড়ে ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডে নাম লেখানোর কারণে ইতালী থেকে স্পটলাইটটা আবারো ইংল্যান্ডমুখী হয়েছে।
সে হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বড় ধরনের একটা বিবর্তনও হয়ে যেতে পারে এবার। মেসির কারণে পিএসজি আর ইংলিশ ক্লাবগুলোর কাছেই চলে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাজত্ব, এমনটাই পূর্বাভাস মিলেছে। একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই গ্রীষ্ম ফুটবলামোদীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ফুটবল বিশ্বের কোন অংশে অর্থের ঝনঝনানি সবচেয়ে বেশি। আর যেখানে যেখানে অর্থকড়ি থাকে, ঠিক সেখানে শিরোপাও সাধারণত তার আশেপাশেই ধরা দেয়। আর সে কারণেই এই মুহূর্তে বাস্তবিকভাবে রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনা কোন দলেরই সামর্থ্য নেই পিএসজি বা ইংলিশ ক্লাবগুলোর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা কার হাতে উঠবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করাটা আগে থেকে আসলেই বেশ কঠিন।
কারণ গত চারটি মৌসুমে চারটি ভিন্ন ক্লাব জিতেছে এই আসরের শিরোপা। এছাড়া সর্বশেষ ছয়টি ফাইনালে নয়টি ভিন্ন দল একে অপরের বিপক্ষে শিরোপা লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু স¤প্রতি আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং করোনাকালীন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যেভাবে ইউরোপীয় ফুটবলের শক্তি কাঠামোর বেশ বড় রকমের মেরুকরণ হয়েছে, তার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই যে মাঠের ফুটবলে পড়তে যাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুরোপুরি সত্য না হলেও পূর্বাভাস বলছে, এ মৌসুমের পাশাপাশি সামনের কয়েক মৌসুমে প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি) এবং ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের (ইপিএল) ক্লাবগুলোর ব্যক্তিগত যুদ্ধে পরিণত হতে পারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। সেখানে বায়ার্ন মিউনিখেরও সুযোগ আছে এদের সাথে লড়াইয়ে সামিল হওয়ার। শিরোপার সমীকরণে থাকা দলগুলোর হাই-প্রোফাইল খেলোয়াড়দেরও থাকতে হয়। এ কারণেই লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানা রোনালদো এই গ্রীষ্মে যথাক্রমে পিএসজি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়ে আলোচনাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সেখানে রেটিংয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও সামনে চলে এসেছে পিএসজি। আর সে কারণেই তাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার সম্ভাবনাটা কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দিয়েছে। মেসি চারবার এবং রোনালদো পাঁচবার নিয়ে মোট নয়বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টাইটেল জিতেছেন। মৌসুম শেষে যদি এদের একজনের নামের পাশে আরেকটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা শোভা পায় তাতেও খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
গত দুই মৌসুমে ইউরোপীয় ফুটবলের শক্তি কাঠামো কতটা বদলেছে সেটা বৈশ্বিক ফুটবলে মহাদেশটির প্রভাব দেখলে সহজে অনুমান করা যায়। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ মৌসুম ধরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনার মতো দলগুলো। এর মাঝে আবার দুইবার ফাইনাল খেলেছে অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ। কিন্তু সর্বশেষ তিন ফাইনালের কোন একটিতে জায়গা করে নিতে পারেনি লা লিগার কোনো ক্লাবই! এই তিনটির মধ্যে দুটিই হয়েছে আবার ‘অল-ইংলিশ ফাইনাল।’
যেখানে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে লিভারপুল ও চেলসির মতো দল। অন্যদিকে রানার্সআপ হয়েছে টটেনহাম ও ম্যান সিটি। এরপর ২০১৯-২০ মৌসুমে পিএসজিকে হারিয়ে বায়ার্ন মিউনিখের শিরোপা জেতাও আমাদের কিছুটা ইঙ্গিত দিচ্ছিল ফুটবল আসলে কোনদিকে যাচ্ছে। স্প্যানিশ ক্লাবগুলো থেকে এখন ইংল্যান্ডমুখী উয়েফার শিরোপা লড়াই।
চলতি সপ্তাহে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলো তাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যাত্রা শুরু করেছে। শক্তির বিচারে শুরুর আগেই কোনো স্প্যানিশ বা ইতালিয়ান ক্লাবের শিরোপা জেতার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিলে কেউ অভিমান করবেনা।
মেসিবিহীন বার্সেলোনা প্রথম ম্যাচেই ০-৩ গোলেৈ পরাজিত হয়েছে বায়ার্নের কাছে। জেনে রাখা ভাল, ম্যাচটির ভেন্যু ছিল বার্সোর নিজস্ব মাঠ ন্যু ক্যাম্প! পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদও একরকম পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, রয়েছে তারকা সংকটে। ১৩৫ কোটি ইউরো ঋণে জর্জরিত থাকা বার্সেলোনা এই গ্রীষ্মে ছেড়ে দিতে হয়েছে মেসিকে, আর বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে আতোয়ান গ্রিজমান, জুনিয়র ফিরপো ও মিরালেম পিয়ানিচের মতো খেলোয়াড়দের। ওদিকে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ৭০ কোটি ইউরোর সংস্কার কাজ ও ক্লাবের ৪০ কোটি ইউরোর ওয়েজ বিলকে সামলাতেই কিনা সার্জিও রামোস, রাফায়েল ভারান ও মার্টিন ওডেগার্ডের মতো দীর্ঘদিনেসর পরীক্ষিত ফুটবলারদের ছেড়ে দিয়েছে মাদ্রিদকে।
গত দেড় কিংবা দুই দশকে এমনটি হতে দেখা যায়নি স্পেনের কোন ক্লাবকে। আর সে কারণেই এই মুহূর্তে তাই বাস্তববাদী হয়ে বলতে হবে, রিয়াল বা বার্সা কারোরই সামর্থ্য নেই পিএসজি বা ইংলিশ ক্লাবগুলোর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একটি নিয়মিত শক্তি হলেও তারা কখনোই পুরো পথ পাড়ি দিয়ে শিরোপা জিততে পারেনি।
যদিও কিছুটা শক্তি বেড়েছে দলটির, তবুও এ মৌসুমে সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও একবারেই ক্ষীণ। ইতালির ক্লাবগুলোর পরিসংখ্যান দেখলে প্রায় একই অবস্থা বলতে হবে। ২০১৫ ও ২০১৭ সালে ফাইনাল খেললেও জুভেন্টাস এবার কোনোমতে জায়গা পেয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে (সিরি এ-তে চতুর্থ হয়ে)। অর্থনৈতিক মন্দা ও ঋণের বোঝা লাঘব করতে দলের সবচেয়ে বড় তারকা রোনালদোকে বিক্রি করে দিয়ে যেন সমস্যার মধ্যে ডুব দিয়েছে।
কোচ অ্যান্থনিয়ো কন্তে, রোমেলু লুকাকু ও আশরাফ হাকিমির মতো মূল তারকাদের হারিয়ে লিগ চ্যাম্পিয়ন ইন্টার মিলান যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার কথা স্বপ্নেও চিন্তাও করছে না, সেটা আগ বাড়িয়েই বলা যায়। এদিকে সর্বশেষ ২০২০ সালে চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জেতা বায়ার্ন এবার দলে ভিড়িয়েছে আরবি লাইপজিগের দায়ত উপামেকানো ও মার্সেল সাবিতজারকে আর হ্যান্সি ফ্লিকের বদলি হিসেবে এনেছে লাইপজিগ কোচ জুলিয়ান নাগেলসম্যানকে। কিন্তু জার্মান চ্যাম্পিয়নদের দীর্ঘদিনের সাফল্য পাওয়া দলটি এবার কতটুকু কার্যকর হবে, তার উপরই মূলত নির্ভর করছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা।
৩৫ বছর বয়সী ম্যানুয়েল নয়্যার, ৩২ বছরের টমাস মুলার এবং ৩৩ বছরের রবার্ট লেভানডোভস্কি এখনো দলের মূল চালিকাশক্তি। সাথে জশুয়া কিমিখ, আলফনজো ডেভিসের মতো তরুণদের সংমিশ্রণে বায়ার্ন বরাবরই ভালো একটি দল তৈরি করলেও এ মৌসুমে পিএসজি আর ইংলিশ দলগুলো যেভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে, তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াটা এবার অনেকটাই কঠিনই হবে বাভারিয়ানদের জন্য।
ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেষ্টার সিটি সার্জিও আগুয়েরোর শূন্যস্থান পূরণে মরিয়া হ্যারি কেন কিংবা রোনালদোকে দলে ভেড়াতে না পারলেও অ্যাস্টন ভিলা থেকে ব্রিটিশ ট্রান্সফার রেকর্ড ১০ কোটি পাউন্ড ফি দিয়ে জ্যাক গ্রিলিশকে ঠিকই দলে টানতে পেরেছে। যদিও কোনো স্বীকৃত সেন্টার ফরওয়ার্ড ছাড়াই গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল ওস্তাদ পেপ গার্দিওলার দল। ইনজুরি জর্জরিত আগুয়েরোর প্রস্থান যে তাই সেভাবে অনুভব করবে না সিটি, সেটা খুব সহজে বলেই দেওয়া যায়।
সিটিকে পরাজিত করে শিরোপা জেতা চেলসি তাদের দলকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করেছে। ইন্টার থেকে ৯.৭৫ কোটি পাউন্ডের বিনিময়ে গোলের মধ্যে থাকা রোমেলু লুকাকুকেদলে ভিড়িয়েছে। অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ থেকে মিডফিল্ডার সাউল নিগুইজকেও দলে ভিড়িয়েছে টমাস টুখেলের দল। লিভারপুল এই মৌসুমে বড় শক্তি মিডফিল্ডার জর্জিনিয়ো ওয়াইনাল্ডামকে হারিয়েছে পিএসজির কাছে, আর লাইপগিজ ডিফেন্ডার ইব্রাহিমা কোনাতেকে দলে ভিড়িয়েছে। দলবদলের বাজারে তেমন সরব না থাকলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সে সম্বন্ধে ভালোভাবেই অবগত ইউরোপে অপরাপর দলগুলো।
ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড এখনো ওলে গুনার সুলশারের অধীনে কোনো শিরোপার দেখা না পেলেও এই মৌসুমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারফরমার দলবদল করতে সমর্থ হয়েছে তারা। ক্রিশ্চিয়ানা রোনালদো, রাফায়েল ভারান ও জ্যাডন সাঞ্চোর মতো তারকাদের অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ডেভিড ডি গিয়া ও পল পগবার মতো তারকাদের ছন্দে ফেরা ইউনাইটেডকেও এবার হিসাবের মধ্যে রাখতে হচ্ছে।
এক লিওনেল মেসির যোগদানের কারণেই আলোর বেশিটা কেড়ে নিয়েছে পিএসজি। অনেকের কাছে প্রশ্নাতীতভাবেই এই মুহূর্তে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দলটির নাম ফরাসী জায়ান্টরা। এই গ্রীষ্মে মেসি, রামোস ও ওয়াইনাল্ডামের মতো তারকাদের দলে ভিড়িয়ে ক্লাবটি জানাতে চেয়েছে, যাদের প্রত্যেকেরই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়া আশরাফ হাকিমি, জিয়ানলুইগি ডোন্নারুমা, নুনো মেন্ডেস ও দানিলো পেরেইরার মতো তরুণদের অন্তর্ভুক্তি মউরিসিও পচেত্তিনোর দলকে একরকম গ্যালাকটিকোতেই পরিণত করে ফেলেছে। সফল ট্রান্সফার উইন্ডো শেষে নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপেকেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে পিএসজি।
তাই দলগত শক্তিমত্তার বিবেচনায় এই মুহূর্তে পিএসজির ধারেকাছেও নেই ইউরোপে কোন দেশের কোনো ক্লাব। স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান পরাশক্তিরা পিএসজিকে আটকাতে পারবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না। শুধু ইংলিশ ক্লাবগুলোই পারে ইউরোপিয়ান ক্লাবটিকে প্রথমবারের মতো শিরোপা প্যারিসে পৌঁছানো থেকে আটকাতে। এ সমীকরণ কিন্তু শুধু এই মৌসুমের জন্য তেমনটি নয়। সামনের কয়েক মৌসুম এই বাস্তবতার সঙ্গেই মানিয়ে নিতে আপনাকে উপরের কথাগুলোর সাথে একমত হতেই হবে।