শচীনের মত একাকীত্ব আর কেউ অনুভব করেনি

১২০ কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ। চাইলেও হয়তো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। ভারতীয় ক্রিকেটে একটা কথা প্রচলিত ছিল, ১২০ কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ মাথায় নিয়ে দাড়ি গুলো সাদা হয়ে গেছিলো মাহেন্দ্র সিং ধোনির। তবে ধোনির আগেও যে মানুষটি এই বিরাট জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার চাপ নিয়ে খেলেছেন ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় তিনি ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার। ২৪ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ফর্ম, ইনজুরি নিয়ে যতটা না ভাবতে হয়েছে শচীনের, তার চেয়ে বেশি তাকে ভুগিয়েছে এই মানুষের প্রত্যাশার চাপ।

১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। তখনকার ক্রিকেটটা ততটা চাপের ছিল না। ছিল না এত মানুষের প্রত্যাশার চাপও। ভারতীয় উপমহাদেশের তখনও ক্রিকেটটা মানুষের জীবনের অনুসঙ্গ হয়ে ওঠেনি। ক্যারিয়ারের প্রথম দশ বছর ক্রিকেটটা অনেকটা প্রত্যাশার চাপ ছাড়াই খেলেছেন শচীন। কিন্তু ১৬ বছরের কিশোর শচীন তারুণ্যের দিকে যেতে থাকলেন আর ক্রিকেটটাকে ভারতীয় মানুষের রক্তে মিশিয়ে দিতে থাকলেন।

শচীনের মাধ্যমেই ক্রিকেটটা নিজেদের করে নিজেদের করে নিলো ভারতের মানুষ। ক্রিকেটের মাধ্যমে বিশাল আয়তনের এই দেশটার মানুষগুলোকে এক করে এক জাতিতে পরিণত করলেন শচীন। ধীরে ধীরে ‘নিজেদের ছেলে’ শচীনের ওপর বাড়তে থাকলো মানুষের প্রত্যাশার চাপও। প্রতিটা ইনিংসেই যেন শচীন নামতেম সেঞ্চুরি করার চাপ নিয়ে। দর্শকরাও আশা করতেন, শচীন ব্যাট করতে নামবেন মানেই সেঞ্চুরি হাঁকাবেন।

তবে দুর্ভাগ্যবশত আরেকটি কথাও প্রচলিত হয়ে গেছিলো ভারতীয় ক্রিকেটে। শচীন সেঞ্চুরি করলেই নাকি ভারত হেরে যায়। যদিও পরিসংখ্যানগত ভাবে মোটেও সঠিক নয় এই কথা। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে শচীনের করা ৪৯ টি সেঞ্চুরি ইনিংসের ম্যাচে ৩৩ টি ম্যাচেই জয় পায় ভারত। তার মানে ৬৭ শতাংশ ম্যাচেই জিতেছে ভারত। তবে পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন, মানুষের এই ধারণা, প্রত্যাশার চাপ সব কিছু মাথায় নিয়েই ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে নামতে হতো শচীনের।

২৪ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন সর্বকালের সেরা এই ব্যাটার। ইনজুরি, অধিনায়কত্ব পাওয়া এবং হারানো, ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে বাদ পড়া সহ নানান বাজে সময়ের মুখোমুখি হয়েছেন শচীন। তবে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও কোচ রবী শাস্ত্রী মনে করেন, শচীনের ওপর যে পারফর্ম করার চাপ ছিল তার কাছে এসব কিছুই ছিল না।

অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদ মাধ্যমে কথা বলার সময় শাস্ত্রী বলেন, ‘যতবারই সে ব্যাটিংয়ে নামত, পুরো জাতি তাঁর দিকে চেয়ে থাকত। কখন সে সেঞ্চুরি করবে সেই অপেক্ষায় থাকত। সে সেঞ্চুরি করতে না পারলেই মানুষ এটিকে তাঁর ব্যর্থতা মনে করতো। আমি জানি এসব কারণে সে মাঝে মাঝে একাকীত্বে ভুগতো। যখন আপনি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছাবেন তখন মাঝে মাঝে আপনার খুব একা লাগবে কারণ আপনি একমাত্র জানেন যে কি ঘটছে তখন।’

শচীনের ক্যারিয়ারের প্রথম সময়টায় শচীনের সাথে জাতীয় দলে খেলেছিলেন রবি শাস্ত্রী। মাত্র ১৮ বছর বয়সের শচীন ১৯৯২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরেই জানান দেন সর্বকালের অন্যতম সেরা হতেই ক্রিকেটে পা রেখেছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার সেই অচেনা আর কঠিন কন্ডিশন আর অজিদের সেই প্রতাপশালী বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে সেই সিরিজের ১৮ বছর বয়সী শচীন করলেন দুই দুটি সেঞ্চুরি। সেই সিরিজে শচীনের সতীর্থ শাস্ত্রী খুব কাজ থেকে দেখেছেন এক কিশোরের বিশ্ব শাসনের পূর্বাভাসের বার্তাটি।

শাস্ত্রী বলেন, `সেবারই প্রথম আমি ২২ গজে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব দেখেছিলাম কাছ থেকে। একটা বিষয় হলো রান করা আর আরেকটা ভিন্ন বিষয় হলো ১৮ বছরের এক তরুণকে অস্ট্রেলিগার বোলিং আক্রমণের ওপর আধিপত্য করতে দেখা। তখন আপনাকে মানতেই হবে এই ছেলেটা আলাদা। সেই তখন থেকেই সে টেন্ডুলকার থেকে ডন ব্রাডম্যান হবার পথে এগোচ্ছিল।’

১৬ বছর বয়সে পাকিস্তানের বিপক্ষে শচীনের অভিষেকের সময়েও একই সাথে খেলেছেন শাস্ত্রী। বিশ্বমঞ্চে শচীনের পা রাখার সময়ের ঘটনা গুলো জানেন খুব ভালো ভাবে। অভিষেক টেস্টে ব্যাটিংয়ে নেমেই ওয়াকার ইউনুসের পেসে রক্তাক্ত হতে হয় শচীনকে। তখন টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে উঠিয়ে নিতে চাইলেও শচীন বলেন, ‘আমি খেলব’। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে প্রথম বলেই স্ট্রেইট ড্রাইভ করে চার মারেন ১৬ বছরের কিশোর শচীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link