দ্য অরিজিনাল খান

ব্রিটিশ শাসনের অবসান ১৯৪৭ সালে হলেও উপমহাদেশের দেশগুলো ক্রিকেট খেলেনি কিংবা ব্রিটিশদের হয়ে ক্রিকেট খেলেছে এমনটা কিন্তু নয়!

এই উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার আগে সবগুলো দেশ কিংবা প্রদেশ থেকে সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে ভারত নামে একটি দল গঠন হয়েছিল যার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল ১৯৩২ সালের ২৫ জুন। সেই দলের মুসলিম ক্রিকেটার কিংবা ভারত উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম ক্রিকেটার হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর খান।

 জাহাঙ্গীর খানের জন্ম ১৯৯০ সালের এক ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জলন্ধরে। তার জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত ক্রিকেট পরিবারে কিংবা যদি বলা হয় তিনি একটি বিখ্যাত ক্রিকেট পরিবারের পূর্বপুরুষ তবে ভুল হবে না! এ পরিবারেই বাকা জিলানি, ইমরান খান, জাভেদ বুর্কি ও মাজিদ খানের জন্ম হয়েছিল।

তাঁর ছেলে হলেন মাজিদ খান। মাজিদের পুত্র বাজিদ খান ২০০৫ সালে পাকিস্তানের পক্ষে খেলেছেন। আর দ্যা ম্যাজেস্টিক মাজিদ তো লম্বা সময় সময় পাকিস্তানকে সার্ভিস দিয়েছেন। আর বাকা জিলানি ছিলেন জাহাঙ্গীর খানের শ্যালক। মাজিদ খান পাকিস্তানের অধিনায়কও ছিলেন। নিজের সময়ে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার ছিলেন।

১৮ বছরের টেস্ট খেলোয়াড়ী জীবনে ৬৩ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন।। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। সামগ্রিকভাবে ৬৩ টেস্টে ৮ সেঞ্চুরিতে ৩৯৩১ রান তোলেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ২৭ হাজারের ওপর রান করেন যেখানে ছিল ৭৩ সেঞ্চুরি ও ১২৮টি হাফ সেঞ্চুরি ছিল। 

এর ফলে হ্যাডলি পরিবারের তিন প্রজন্মের ধারাবাহিক টেস্ট ক্রিকেটারের অংশগ্রহণের পর তার পরিবার দ্বিতীয় হবার মর্যাদা পায়। তবে, মজার ব্যাপার হল, এই খান পরিবার খেলেছেন দু’টি ভিন্ন দেশের হয়ে।

জাহাঙ্গীর খান (ডানে)

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর খান লাহোরের ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছিলেন। ১৯৩২ সালের ইংল্যান্ড সফর শেষে ইংল্যান্ডে অবস্থান করেন। ক্যামব্রিজে ভর্তি হন ও চার বছর একাদশ দলের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেন। মিডল টেম্পল থেকে ফাইনাল বার পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ঐ সময়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারবার ‘ব্লু’ খেতাব পান।

১৯২৯ সালের মার্চে লাহোরের লরেন্স গার্ডেন্সে দর্শনীয়ভাবে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সূচনা ঘটে জাহাঙ্গীর খান এর। অভিষেক ইনিংসে ১০৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এরপর প্রথম ইনিংসে ২/২৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৭/৪২ নিলে মুসলিম দল ইনিংস ও ৮৮ রানের ব্যবধানে জয় পায়।

মিডিয়াম ফাস্ট বোলার ও আক্রমণাত্মক ডান-হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে ১৯২৮-২৯ মৌসুম থেকে ১৯৫১-৫২ মৌসুম পর্যন্ত জাহাঙ্গীর খানের প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড়ী জীবন চলমান ছিল। 

১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত লর্ডসে অক্সফোর্ডের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান। শেষ দুই বছরে ক্যামব্রিজের জয়ে ভূমিকা রাখেন। প্রতি মৌসুমে ছয়টি করে উইকেট পেয়েছিলেন। নিখুঁত বোলিং ও উদ্যমী মনোভাবের ফলে প্রতিপক্ষে ব্যাটসম্যানদেরকে দীর্ঘক্ষণ হতাশার কবলে ফেলে রাখতো।

১৯৩৩ সালে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে এগারো উইকেট পেয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে ইন্ডিয়ান জিমখানার পক্ষে খেলেন। দুই মাসে ৭০ গড়ে ১৩৮০ রান তুলেছিলেন। ১৯৩৬ সালে ফেনার্সে ক্যামব্রিজের সদস্যরূপে নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে ব্যক্তিগত সেরা ১৩৩ রান তোলেন। ক্যামব্রিজে থাকাকালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়ন ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ব্যক্তিগত সেরা বোলিং ফিগারের দেখা পান। সাত উইকেট পান ৫৮ রানের বিনিময়ে। 

এ চার বছরে ৩৯ খেলায় ২৪.৮১ গড়ে ১৫১৪ রান দুই সেঞ্চুরি সহযোগে করেন। বল হাতে ২৫.৪৭ গড়ে ১৩৪ উইকেট পান। ছয়বার পাঁচ উইকেট ও খেলায় একবার দশ উইকেট পেয়েছিলেন।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করা জাহাঙ্গীর খানের খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি জাতীয় দলের হয়ে। কারণ, অভিষেকের পরপরই ইংল্যান্ডে চলে যান কেমব্রিজ এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের জন্য। সেখানে ৪-৫ বছর অবস্থান করেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট পুরোদমে চালিয়ে গিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর খান চারটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। সবগুলোই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৩২ সালে প্রথম টেস্ট খেলার পর বাকি তিনটি ম্যাচ খেলেছিলেন ১৯৩৬ সালে। চার ম্যাচে ব্যাট হাতে করেছিলেন ৩৬ রান আর বল হাতে শিকার করেছিলেন চার উইকেট।

ভারত ভাগের পর ১৯৫১-৫২ মৌসুম থেকে ১৯৫৫-৫৬ মৌসুম পর্যন্ত পাঞ্জাবের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ সময় তার বয়স ছিল ৪৬ বছর। ১১১টি প্রথম-শ্রেণির খেলায় অংশ নিয়ে ২২.১২ গড়ে ৩৩১৯ রান করেছেন। চারটি শতরানের ইনিংস খেলেছিলেন। ২৫.০৬ গড়ে ৩২৮ উইকেট লাভ করাসহ ৭৯ ক্যাচ তালুবন্দী করেছেন। ১২ বার পাঁচ-উইকেট ও দুইবার খেলায় দশ উইকেট পেয়েছিলেন। 

অবসরের পর পাকিস্তান ক্রিকেট দলের নির্বাচক এবং পরিচালক এর দায়িত্ব ও পালন করেছেন। ২৩ জুলাই, ১৯৮৮ তারিখে পাঞ্জাবের লাহোরে ৭৮ বছর বয়সে দেহাবসান ঘটে জাহাঙ্গীর খানের। নিজ শহরে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। জীবদ্দশায় তিনি ভারতের পক্ষে প্রথম টেস্ট খেলা সর্বশেষ জীবিত খেলোয়াড় ছিলেন। অথচ, তখন তিনি ছিলেন ভিন্ন একটা দেশের নাগরিক!

অন্যরকম একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি। ১৯৩৬ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলার সময় জাহাঙ্গীরের বলে একটা ঊড়ন্ত চড়ুই পাখির মৃত্যু হয়। ম্যাচটা হচ্ছিল লর্ডস, ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে। সেই বল ও পাখিটার মৃতদেহ আজও লর্ডস স্টেডিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link