সেই মহাজাগতিক কুটিরের মালিক

পদ্যের পঙক্তিগুলির ওপর ধুলোবালির আস্তরণ একদিন কবিতার বইকে রুপান্তর করে দেয় আস্ত একটি গদ্যতে। গদ্যের চেহারার ধুসর রূপের নীচে ঢাকা পড়ে থাকে কত্ত স্কোরকার্ড, কত্ত স্ট্র‍্যাটেজি! তা পড়তে পড়তে নিদ্রাহীন ক্লান্ত পাঠকের চোখে লেগে যায় ঘুমের ছাপ, ক্রিকেটের সহিত সংযোগ বিচ্ছিন্নতার ভয়ে উদ্ভব হয় ক্রীড়া লিখিয়েদের।

পদ্যের পঙক্তিগুলির ওপর ধুলোবালির আস্তরণ একদিন কবিতার বইকে রুপান্তর করে দেয় আস্ত একটি গদ্যতে। গদ্যের চেহারার ধুসর রুপের নীচে ঢাকা পড়ে থাকে কত্ত স্কোরকার্ড, কত্ত স্ট্র‍্যাটেজি! তা পড়তে পড়তে নিদ্রাহীন ক্লান্ত পাঠকের চোখে লেগে যায় ঘুমের ছাপ, ক্রিকেটের সহিত সংযোগবিচ্ছিন্নতার ভয়ে উদ্ভব হয় ক্রীড়া লিখিয়েদের।

সাহিত্যের নদী আবার বইতে শুরু করে ক্রিকেটপ্রেমীদের পাশ দিয়ে, সে নদীর বয়ে চলার শব্দে আবার ঘুম ভাঙে ক্লান্ত পাঠকের, ক্রিকেট রোমান্টিসিজমের গন্ধ আবার মনে করায় তাকে উইলো কাঠের আওয়াজ, সবুজ গালিচা আর বাইশ গজের শুকনো মাটিদের মহিমাসমুহ!

বিশ্ব ক্রিকেটের মূর্তিমানদের ঠাসা ইতিহাস নিয়ে লেখায় আবারো যখন পাঠক ক্লান্ত হয়ে পড়ে, হঠাৎ সামনে ভেসে ওঠে গৌতম গম্ভীর! স্কোরকার্ড, রেকর্ড, স্ট্যাটিকটিকস ইত্যাদিদের সাতকাহনের বাইরে আরো একটি ক্রিকেট রোমান্টিসিজম আছে যে!

ক্যারিয়ারে রেকর্ড বলতে আহামরি কিচ্ছু নেই, তাই কিংবদন্তির গপ্পের আসরে গম্ভীরের নাম ওঠেনা খুব একটা। হ্যাঁ, বিশ্বকাপ ফাইনালে একবার দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেলেছিলেন অবশ্য, তাই রেকর্ড-পরিসংখ্যানের বিচারে মানুষের মাঝে গম্ভীর আজ নেই প্রায়।

তবু, ভারতের ১৩৫ কোটি মানুষের হৃদয়ের অন্তর্দেশে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে রয়েছেন আজও! বাইশ গজে আর নেই গম্ভীর; ফাইনালের তাঁর পরিত্রাণসুলভ ইনিংস ছাড়াও আরো কটা রক্তক্ষয়ী ইনিংসের কালসিটে দাগ আজও আটকে রয়েছে বাইশগজের গুঁড়োমাটির ওপর।

কিউইদের দেশ থেকে ৩৫-৪০ বছর পর একটা টেস্ট সিরিজ ছিনিয়ে নিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছে টিম ইন্ডিয়া। ভারতীয় দলে যুক্ত হয়েছে কয়েকজন নবীন খেলোয়াড়ও। ২০০৯ সাল, নিউজিল্যান্ডের ঝকঝকে সকালে যখন টিম ইন্ডিয়া মাঠে নামছে ভারতে তখন ভোর-রাত। ঠাণ্ডা-যুদ্ধ চলছে দুই দলের মধ্যে, প্রতিটি ইনসুইং প্রতিটি বাউন্সার খেলায় ক্রমাগত টুইস্ট আনছে।

সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তিনশো প্লাস লিড ঘাড়ে নিয়ে ফলো-অনে যখন ব্যাট করতে নামছে ভারত ততক্ষণে ম্যাচ বাঁচানোর আশা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে ভারতীয় সমর্থকেরা। নেপিয়ারের আকাশে দুলতে থাকা সাদা পাখিরাও বুঝে গেছে ম্যাচ এখন যে অবস্থায় তাতে ভারতের পরাজয় প্রায় অসন্দিগ্ধ!

দক্ষিণ-পুর্ব থেকে যত সরে যাচ্ছে সুর্যের আলো, যত প্রখর হচ্ছে রোদ, লড়াইটা ক্লিন-শেভড মুখটার দিকে আরো ছুটে আসছে। আগের ইনিংসের প্রেসার, নিখুঁত বোলিং আর আগ্রাসী ফিল্ডিং সেট সবকটার উর্ধ্বে গিয়ে নিশ্বাস ফেলতে হবে। আরো দেড় দিনেরও বেশি ঠুকে থাকতে হবে ক্রিজের ওপর। তাই হালকা হাতে ওভারের পর ওভার খেলে চললেন গম্ভীর কখনও দ্রাবিড়কে নিয়ে কখনও লক্ষণকে নিয়ে কখনও শচীনকে নিয়ে।

চতুর কিউই অধিনায়ক সবকিছু বুঝে নিয়ে হটাৎই ফিল্ডার ঘিরে দিলেন একদম শর্টে ; শর্ট পয়েন্ট, শর্ট লেগ, শর্ট থার্ডম্যান, লেগস্লিপ, গালি আর তার সাথে ড্যানিয়েল ভেট্টোরি। মনে আছে, যতবার গম্ভীরকে তারা ক্লোজ ফিল্ডার দিয়ে আক্রমণ করতে চেয়েছে ততবার এক-দুই স্টেপ এগিয়ে এসে ডাউন দ্য ট্র‍্যাকে মিড উইকেট অথবা লং অন দিয়ে ক্লিয়ার করেছেন বলটাকে! চারশোর বেশি ডেলিভারী ফেস করে টিম ইন্ডিয়াকে এক অনিবার্য পরিণতির হাত থেকে রেহাই দিয়েছিলেন সেদিন। পরের টেস্টেও হাঁকিয়েছিলেন শতরান!

তখনও শতক থেকে তিন রান দুরে গতি, এদিকে নবাগত টিম সাউদি তার রিভার্স দিয়ে উদ্বিগ্ন করে চলেছে গম্ভীরকে; অন্যদিকে স্ট্যান্ডিং ওভেশনের জন্য প্রস্তুত সকলে, তাই দু-এক পা সামনে বাড়িয়ে রিভার্স কভার করে এক্সট্রাকভার দিয়ে উড়িয়ে দিলেন সাউদিকে।

তার পরের বলটাতে আবার অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিমায় ব্যাটের সুস্পর্শে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট-থার্ডম্যান দিয়ে জুড়ে দিলেন আরেক বাউন্ডারি। ১৬৭ রানের এই ইনিংসের দাগ হয়তো এখনও লেগে আছে ওয়েলিংটনের ঘাসের ওপর যেটি তাঁর জার্সিতে ছাপিয়ে দিয়েছিল নাম্বার ওয়ান টেস্ট র‍্যাঙ্কার।

এখানেই তিনি নায়ক নন, তিনি জাতীয় পতাকার বিনিদ্র প্রহরী, এখানেই তিনি নন্দিত নন, তিনি এক প্রাচীর। লাল রঙে লড়াইয়ের সংজ্ঞা নিরূপিত করতে যিনি ভাঙা কনুইয়ের দুঃসহ যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বাইশ গজে হেঁটে চলেন। তাই তো ক্রিকেট রোমান্টিসিজমের চেয়ে আজ অনেকাংশে এগিয়ে থাকেন একজন গৌতম গম্ভীর।

কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারে বোধহয় সাজানো রয়েছে আরো একটি মহাজাগতিক কুটির, সে কুটিরে রণলিপ্সু সিপাহীদের রক্তবিন্দুর সাথে মিশে রয়েছে আরো কত ইতিহাস! সে কুটিরের সামনে অবিরাম দুলে চলেছে মনুষ্যত্বের ফুলেরা আবার সেই ফুলেদের ওপর লেগে রয়েছে বিশ্বজয়ের সুবাস।

দুর্গম দুরূহ এমন পর্বতমালার ওপারের সুদৃশ্য কুটিরে যে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না! সবার কাছে এই মহাশক্তিও থাকে না। যিনি পারেন তিনি সীমান্তে যুদ্ধরত ক্লান্ত সৈনিকের ললাট থেকে খসে পড়া এক ফোঁটা রক্তবিন্দু সংগ্রহ করে ফ্লাডলাইটের দ্যুতির নীচে মুড়ে দিয়ে আসেন একটা স্কোয়ার কাট, শরীরের শেষ ঘামটা ফেলে দিয়ে আসেন মাঠেই। হ্যাঁ তো, তিনিই কাঞ্চনজঙ্ঘার পেছনে অবস্থিত সেই মহাজাগতিক কুটিরের মালিক, গৌতম গম্ভীর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link