বোথাম-ভিভ ও রোবাকের রহস্যময় জীবন-মৃত্যু

ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক টেস্ট সিরিজের নাম আর ‘উইজডেন ট্রফি’ নেই ২০২০ সাল থেকে। এর নাম রিচার্ডস-বোথাম ট্রফি। সঙ্গে সঙ্গে চোখে ভেসে উঠল সমুদ্রপাড়ে স্যার ইয়ান বোথাম আর স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের সেই বিখ্যাত ছবিটা। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত ভালো বন্ধু তারা। আর কোথাও পড়া একটা ঘটনা আবছা মনে পড়ছিল যে, ভিভকে কোনো একটা কাউন্টি দল থেকে বাদ দেয়ায় প্রতিবাদস্বরূপ বোথামও সে দলে আর খেলেননি।

গুগল করলাম। ১৯৮৬ এর গ্রীষ্মের কথা। সমারসেট কাউন্টিতে ভিভের দ্বাদশ বছর। সে মৌসুমে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে ১৬তম হয় সমারসেট। এহেন বাজে পারফরম্যান্সের পর দলের দুই বিদেশি তারকা ভিভ রিচার্ডস আর জোয়েল গার্নারকে আর দলে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সমারসেট। এতে বেজায় চটে যান বোথাম। নিজেও সমারসেট ছেড়ে চলে যান। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমারসেট অধিনায়ক পিটার রোবাকের সাথে তার বাদানুবাদ হয়। রোবাক আর বোথামের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আর কখনোই মেটেনি। অনেকদিন পরেও রোবাক বলেছেন, ‘সেবারের জন্য বোথামকে কখনোই আমি ক্ষমা করব না।’

পিটার রোবাক নামটা আমার পরিচিত। ঘাঁটাঘাঁটি করলাম একটু। ভদ্রলোক ছিলেন বেশ সম্মানিত একজন ক্রিকেট লিখিয়ে ও রেডিও ধারাভাষ্যকার। কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছেন সেটা তো লিখলামই। প্রায় দশ বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু এমন একটা বিষয় চোখে পড়ল যেটা না লিখে পারছি না।

১৯৯১ সালে ডেভিড ফ্রিথ একটা বই লিখলেন ৮০ জন ক্রিকেটারের গল্প নিয়ে। বইয়ের নাম ‘By His Own Hand’. নাম দেখেই কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে বইটি আসলে কী নিয়ে লেখা। আর্থার শ্রুসবেরি, সিড বার্নস সহ যে ক্রিকেটাররা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তাদের গল্পই তুলে এনেছিলেন ফ্রিথ। সে বইটার ভূমিকা লিখেছিলেন পিটার রোবাক।

দশ বছর পর বইটির নতুন সংস্করণের ভূমিকা লিখেন মাইক ব্রিয়ারলি। রোবাককে দিয়ে না লেখানোর কারণ হয়ত উইজডেন ক্রিকেট মান্থলি আর দ্য ক্রিকেটার নিয়ে দুজনের মধ্যকার দূরত্ব। বইটির নাম পাল্টে ফ্রিথ রেখেছিলেন ‘Silence of The Heart’. কিন্তু প্রথম সংস্করণটিতে এখনও শোভা পাচ্ছে রোবাকের লেখা ভূমিকাটি – ‘Cricketers are supposed to be simple, even gung-ho, in sexual matters as in everything else. And yet cricket and most cricketers has its dark secrets, its skeletons.’

কে জানত, বিশ বছর পর রোবাকের ভূমিকায় লেখা কথাগুলোই তার মৃত্যুর কারণ হবে?

১৯৯৯ সালে রোবাক তিনজন দক্ষিণ আফ্রিকান উঠতি ক্রিকেটারকে কোচিং করানোর প্রস্তাব দেন এবং নিজের বাসায় ওদের থাকতে দেন। কিন্তু অভিযোগ ওঠে যে তাঁদের সাথে ‘অশ্লীল’ আচরণ করেছেন রোবাক। জটিল এক জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে বেশ অনেক বার। যা তার শেষ জীবনেও অব্যাহত ছিল। অভিযোগও ছিল যে তাদের সাথে করা আচরণ যাতে বাইরে প্রকাশ না পায় তার জন্য তাদের ব্ল্যাকমেইলও করেছেন রোবাক।

সিডনি মর্নিং হেরাল্ড আর এবিসির হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ কাভার করতে রোবাক কেপ টাউনে পৌঁছেন ২০১১ সালের ৭ নভেম্বর। অবস্থান করছিলেন সাউদার্ন সান হোটেলে। ১২ তারিখ তার হোটেল রুমে দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ সার্ভিসের লোকেরা পৌঁছে, কেননা ২৬ বছর বয়সী এক জিম্বাবুইয়ান তরুণ তার বিরুদ্ধে একই রকম ‘অশ্লীল’ আচরণের অভিযোগ করেছিলেন।

রোবাক পুলিশের কাছ থেকে কাপড় পাল্টানোর অনুমতি নিয়ে অন্য রুমে যান। গিয়ে এবিসির জিম ম্যাক্সওয়েলকে ফোন করে বলেন তার জন্য একজন আইনজীবী খুঁজে নিয়ে তার রুমে আসতে।

কিন্তু রাত সোয়া নয়টায় সাউদার্ন সান হোটেলে তার রুমের জানালা দিয়ে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন পিটার রোবাক। মরচুয়ারিতে তার লাশ দেখতে গিয়েছিলেন ক্রিকেট লিখিয়ে পিটার লালর। লালরের মতে, মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত হয় রোবাকের।

দেখুন তো, ডেভিড ফ্রিথের বইয়ে পিটার রোবাকের লেখা ভূমিকার সাথে তার নিজের জীবনটা মিলে যায় কিনা?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link