ধ্রুপদী কর্ণাটকীয় শক্তি

স্তব্ধতার গান শুনতে শুনতে রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। স্যা ডন ব্র্যাডম্যানের নিজস্ব সাম্রাজ্য, অন্ধকার সিডনি শুনশান।

কিছু গ্রাউন্ড স্টাফ এসে দেখে যাচ্ছে পিচের ছাউনি। দু একটা হুইসেল ছাড়া তেমন কোনো শব্দ নেই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের (এমসিজি) চত্বরে। দক্ষিণ দিকের গ্যালারির যে অঞ্চল থেকে ক্রমাগত বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য ছুঁড়ছিল অজি সমর্থকরা সেখানে কিছুটা জায়গা ঔদ্ধত্যের আগুনে কালো হয়ে আছে। কাল এখানেই গোলাপ ফুটবে হয়তো।

হেরে যাওয়ার গল্প, ব্যর্থতার গল্পের চাইতে উত্থানের গল্প চিরকাল জনপ্রিয়। সরল অংক বলছে ৯০ ওভার, ৩০৯ রান, আট টা উইকেট। বিজ্ঞান বলছে সম্ভাবনা কম। টেস্টের শেষ লগ্নে তিন স্লিপ, গালি, শর্ট ফাইন লেগের অগ্নিকুন্ডের মাঝে শান্ত ব্যাটসম্যানের বুটের স্পাইকের ডগায় যেটুকু মাটি উঠে আসে ক্রিজ থেকে সেখানে বোধ হয় একটা কেমিস্ট্রির ফর্মূলা লেখা থাকে। একটা ছোট্ট আউটসাইড এজ সেখানে এলোমেলো করে দেয় সব।

‘ব্যালেন্স কমল, ব্যালেন্স …’ – বুড়ো ঘোড়া কমল গুহর সেই ব্যালেন্স যেন টেস্ট ক্রিকেটের সাজানো পঞ্চব্যঞ্জনের নুন, এক চিলতে এদিক ওদিক হলেই গোলমাল। প্রতিটা বল আসলে প্রতিটা পরিকল্পনা নিয়ে ছুটে আসে ব্যাটসম্যানের দিকে।

লড়াইটা এখানেই, লড়াইটা ব্যাট বলের না, লড়াইটা অনেক বেশি মনের সংকেতকে ডিকোড করার। লড়াইটা কি অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার বিদ্রূপের সাথে? অজি জনতার ফের একবার পুরোনো আগ্রাসন ফিরিয়ে আনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর? নাকি এলোমেলো চুল আর খসখসে গালের কোনো চেতেশ্বর পূজারাই শেষবার ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন লড়াইটা লড়তে?

কে জানে সে কোন টেলিপ্যাথি, কোন টেলিপ্যাথির জোরের কথা এখনো আঁকড়ে ধরে আছে ফেলুদা, প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। আমাদের টেলিপ্যাথি বারবার বলে চতুর্থ ইনিংসে ভারতের স্কোরবোর্ডের অদৃশ্য নাম হোক ভিভিএস লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড়।

সে তো অনেককাল আগের কথা। সেই কোন ইডেন গার্ডেন্সের বিকেলে অজি বিজয়ের ললাটলিখন ছিঁড়ে ঢুকে গেছিল দুটো উইলো কাঠের ব্যাট, কিংবা এডিলেডের বাউন্সারের কাছে বারে বারে আঘাত পেয়েও উঁচিয়েছিল টাইটানিয়াম হেলমেট। আসলে সেদিন থেকে আজ অবধি সবটাই ভারত লড়েছে। লড়ছে নতুন দশকের এই সিডনিতেও।

সিডনি থেকে হাজার হাজার মেইল দূরে ব্যাঙ্গালুরুতে বসে আছেন রাহুল দ্রাবিড়, দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ওয়াল। দেয়ালের গায়ে আরেকটা ইঁট গাঁথা হবে। সেই গোলাবারুদের যুদ্ধ থেকে অনেক দূরে দেয়ালের গায়ে এখন অনেকটা সবুজ, তরুণ প্রতিভারা ডানা মেলছে সেখানে,তবু এসব লড়াই তো আদতে এক। সেকাল একাল, দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ থেকে পূজারা-রাহানে, সব একই লড়াই, সবার পরিণতি হয়ত আলাদা!

আসলে যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া, সত্যিই তো, তেরঙা পতাকার জন্য লড়াইটা তো একই, কালের নিয়মে যোদ্ধারা আসছেন মাত্র, দ্রাবিড় চায়ে চুমুক দিতে দিতে চেয়ে থাকবেন স্কোরবোর্ডে, হয়ত নিশ্চিত হার, কিংবা ফিনিক্স পাখির মত ফিরে এসে লড়াই করে পাওয়া কোনো বিস্ময় – যাই হোক না কেন – তবু প্রতিটা বলে সে ধ্রুপদী কর্ণাটকীর শক্ত হবে মুঠো, চলকে পড়বে পুরোনো স্মৃতির পেয়ালা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link