বর্তমান ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে শক্তিশালী দল কোনটি, এমন প্রশ্নে প্রথমেই যে দুই-তিনটি দলের নাম আসবে তাদের একটি নি:সন্দেহে ম্যানচেস্টার সিটি। ধনী ব্যবসায়ী শেখ মনসুরের মালিকানায় আসার পর থেকেই নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে দলটি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জেতা এখন তাদের জন্য নিয়মিত দৃশ্য বটে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ না জিতলেও এই টুর্নামেন্টেও দাপুটে পারফরম্যান্স করে থাকে সিটিজেনরা।
শুধু নিয়মিত একাদশ নয়, ম্যানসিটির সাইড বেঞ্চ এবং বয়সভিত্তিক দলগুলোও বেশ শক্তিমত্তা সম্পন্ন। বলা যায়, বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যতও গুছিয়ে নিচ্ছেন সিটি বস পেপ গার্দিওলা। ম্যানচেস্টার সিটির অনূর্ধ্ব ২৩ দলের খেলোয়াড়দের মান দেখে আশ্চর্য হতে বাধ্য হবে যে কেউ। কোল পামার এবং জেমস ম্যাকাটির মতো আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারদের ফুটবলীয় দক্ষতা এবং ফার্স্ট টাচ, পজিশনিং সেন্স অথবা লুক এমবেটের মতো একজন সেন্টার-ব্যাকের আত্মবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হতেই হয়।
একটা কথার প্রচলন অবশ্য আছে যে আপনার যদি নির্দিষ্ট কৌশল না থাকে, তাহলে আপনি কোনভাবেই বিশ্বের সেরা দলগুলোকে গুছানো ফুটবলের প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন না। সেরা কোচ হতে চাইলে অবশ্যই কার্যকরী এবং সময়োপযোগী ট্যাকটিক্স জানা উচিত। দলীয় সাফল্য আর শক্তিশালী পাইপলাইন দেখে কৌতূহল জাগতেই পারে, পেপ গার্দিওলা ফুটবল কোচিংয়ে রহস্য কি! তিনি আসলে কোন ট্যাকটিক্স অনুসরণ করে থাকেন!
পেপ গার্দিওলা শুনলে বার্সেলোনার টিকি-টাকা ফুটবলের কথা মনে পড়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অবাস্তব ভাবলেও সত্যি যে, এই ট্যাকটিশিয়ান মোটেও টিকি-টাকা ফুটবল পছন্দ করেন না। অবশ্য পেপ নিজেও পাসিং ফুটবলের সাহায্যেই দল পরিচালনা করেন কিন্তু সেটা টিকি-টাকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
গার্দিওলার মতে, ‘টিকি-টাকা ট্যাকটিক্সের মানে হলো কোন স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়াই বল পাস করতে থাকা। এবং এটা বলতে গেলে অর্থহীন।’ অন্যদিকে পেপ গার্দিওলার পছন্দ ‘পাস অ্যান্ড মুভ’ ট্যাকটিক্স। অর্থাৎ জায়গায় দাঁড়িয়ে পাস খেলার চেয়ে সামনে এগুতে এগুতে বল আদান-প্রদান করাটা তাঁর নির্দেশ। এর ফলে টিকি-টাকার মত ধীরগতিতে নয়, বরং খুব দ্রুততার সাথেই আক্রমণে উঠে আসতে পারছে ম্যানচেস্টার সিটি।
এছাড়া গোল করাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেন পেপ গার্দিওলা। আর তাই শিষ্যদের দৃঢ়ভাবে শুটিংয়ের উপর জোর দিতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন এই ট্যাকটিশিয়ান। বল পায়ে আসা মাত্রই প্রথম চিন্তা হতে হবে একটি দারুণ শট নেওয়া অথবা বিকল্প হিসেবে একজন সতীর্থকে খুঁজে বের করা যে একই কাজ আরো ভালভাবে করার মত পজিশনে আছে।
এটি মূলত খেলোয়াড়দের মনোযোগ বৃদ্ধি করে এবং অহেতুক ড্রিবলিংকে নিরুৎসাহিত করে। সবচেয়ে বড় কথা এই নির্দেশনা অনুসরণ করার ফলে মাঠে থাকা খেলোয়াড়রা একটি সংগঠিত দল হয়ে খেলতে পারে। এবং আক্রমণের ক্ষেত্রে আরো ক্ষুরধার আর অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে প্রতিরক্ষা পেপ গার্দিওলার ফুটবলীয় দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ডিফেন্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ট্যাকলিং এবং শট ব্লক করার মত মৌলিক বিষয়গুলোর উপর তিনি জোর দেন। তাছাড়া দ্রুত বল ফিরে পাওয়ার জন্য হাই-প্রেসিং, প্রতিপক্ষের পাসিং চ্যানেল বন্ধ করার মত ট্যাকটিক্স প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন এই স্প্যানিশ কোচ।
বল গোলপোস্টের যত দূরে থাকবে, প্রতিপক্ষের পক্ষে গোল করা ততই কঠিন – এমন সহজ একটি বিষয় গার্দিওলার দলের মূলমন্ত্র। আর এজন্য যতটা সম্ভব হাই লাইন ডিফেন্স করার চেষ্টা করে থাকে ম্যানচেস্টার সিটি। আবার ডিফেন্স থেকে আক্রমণে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এই ট্যাকটিক্স বেশ কার্যকরী।
এসবের পাশাপাশি পেপ গার্দিওলা সবসময় খেলোয়াড়দের পিছনের দিকে না যাওয়ার জন্য বলে থাকেন অর্থাৎ ব্যাক পাস যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য। খেলোয়াড়দের সবসময় আক্রমণ করার বিষয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত করা হয়। এটি বেশ সহজ শোনায় কিন্তু এমন কৌশলের ফলে বলের দখল হারানোর ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই মাঠের এগারোজনকে সবসময় বেশ মনোযোগী আর পরিশ্রমী হতে হয়।
সিটিজেনদের মাঠের পজিশনিং ডায়াগ্রাম দেখলেই প্রতিটি খেলোয়াড়ের অবস্থান এবং পাসিং লেন বোঝা যায়। এক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা বিশেষ ধরনের ত্রিভুজ আকৃতিতে অবস্থান করেন। যার ফলে ফুল-ব্যাক এবং উইঙ্গাররা অনেক সহজেই সতীর্থদের কাছ থেকে বলের যোগান পেয়ে থাকেন।
বল দখলে থাকার সময় আত্মবিশ্বাসী থেকে খেলাটি উপভোগ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই মনোভাব সিটিজেনদের প্রথম একাদশ থেকে ক্লাবের সব বয়সভিত্তিক দলের মাঝে দৃশ্যমান। এই কারণেই ফিল ফোডেন, কেভিন ডি ব্রুইনার মতো খেলোয়াড়রা নিজেদের স্বাভাবিক ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই সেরা খেলাটা খেলছেন।
এত এত সাফল্য আর অভিজ্ঞতার পরেও পেপ গার্দিওলা বলেছেন তিনি এখনও শিখছেন। তার এই শেখার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই পরিপূর্ণ হয়ে বেড়ে উঠছে সিটিজেন তরুণরা। মূল দল তো এখন অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ, ম্যানচেস্টার সিটিকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আর এই নিশ্চিত ভবিষ্যতের মূল কারিগর কিন্তু টেকো-মাথার পেপ গার্দিওলা।