দুর্দান্ত গতিতে বল করতে পারতেন শুরু থেকেই, বল হাতে কারিকুরি করার ক্ষমতাও ছিল। আর এসবের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আগের চেয়ে অনেক পরিণত ক্রিকেট-মস্তিষ্ক। সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের বড় এক অস্ত্র।
হ্যাঁ, বলছি প্রত্যাবর্তনের মহাকাব্য লেখা এক বাংলাদেশি ফাস্ট বোলারের কথা; নাম তাসকিন আহমেদ। এশিয়ার স্লো উইকেটে মুস্তাফিজুর রহমান হয়তো পেস বোলিংয়ের নেতা, তবে দেশের বাইরের বিশেষ করে সেনা কন্ডিশনের গতিময় উইকেটে সেই স্বীকৃতিটা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাসকিন সবচেয়ে এগিয়ে। গতিতে ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দেওয়ায়, বলের মুভমেন্টে অস্বস্তিতে ফেলায়, ড্রেসিংরুম – গ্যালারিতে ‘এই বুঝি কিছু ঘটে গেলো’—এমন চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি; সবকিছুতেই এখন পটু হয়ে উঠেছেন তাসকিন।
শুরুর তাসকিনেও এটা ছিল, এখন তাতে মাথা খাটানোও যোগ হতে দেখা যাচ্ছে। তাসকিন এখন তাই পরিপূর্ণ এক ফাস্ট বোলার। কন্ডিশন কিংবা পরিসংখ্যান পাশে রেখে এখন যাকে নিয়ে ভাবতে হয় প্রতিপক্ষকে। ক্রিকেট-মস্তিষ্ক যে পরিণত হয়েছে, ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝে সে অনুযায়ী বল করতে পারার ক্ষমতা যা তাঁর মধ্যে জন্মাচ্ছে -তার প্রমান প্রত্যাবর্তনের শুরু থেকেই দেখাচ্ছেন তাসকিন। তবে আরো স্পষ্টভাবে, রীতিমতো দর্শকেদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পারফরম্যান্স দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি প্রস্তুত বাংলার ফাস্ট বোলিং জাহাজের ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৩৬ রানে তিন উইকেট; তবে সাকিব,লিটন,ইয়াসির কিংবা মিরাজের ভিড়ে একটু যেন অন্ধকারেই ছিলেন তাসকিন। তবে যার রক্তে মিশে আছে ঘুরে দাঁড়ানোর গান তাকে দমিয়ে রাখবে কে? সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে’তে ব্যাটসম্যানদের ভুলে লড়াইয়ের পুঁজি না পেলেও তৃতীয় ওয়ানডে’তে দেখিয়ে দিলেন নিজের সামর্থ্য। সব আলো কেড়ে নিলেন নিজের দিকে। ৯ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩৫ রান খরচায় নিয়েছেন পাঁচ উইকেট।
শুধু সংখ্যায় নয়, টাইট লাইন-লেন্থ আর বাউন্সারে ব্যাটসম্যানদের জন্য যেন যুদ্ধ ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। প্রতিটা বল গোলার মত ছুড়ে দিচ্ছিলেন প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের দিকে।
পাঁচজনের মধ্যে চারজনকেই উইকেটের পিছনে মুশফিকের গ্লাভসে বন্দী করেছিলেন। আর শুরুটা ছিল কাইল ভেরাইনকে বোল্ড করার মধ্য দিয়ে। তাসকিন একাই সেঞ্চুরিয়ানে বাংলাদেশের সিরিজ জেতার মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন। বল হাতে লাইনলেন্থ গতি আর বল ছাড়াও আগ্রাসন, উদযাপন; সবমিলিয়ে তাসকিন ছিলেন পারফেক্ট ফাস্ট বোলার। একজন এশিয়ার বোলার সেনা কন্ডিশনে এতটা দাপট দেখাবে বিশেষ করে বাংলাদেশি কেউ তা হয়তো কল্পনায় ছিল; সেই কল্পনা আজ সত্যি করে দেখালেন ২৭ বছর বয়সের এই পেসার।
এর আগের ফাইফারটি ২০১৪ সালে; ওয়ানডে অভিষেকে। দুর্দান্ত বোলিংয়ে সেদিন ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু করা তাসকিন এরপর মাশরাফি’র সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামলেছিলেন বাংলাদেশের পেস আক্রমন। ২০১৫ বিশ্বকাপের দলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কাণ্ডারি হওয়ার। ভারত সিরিজেই মোস্তাফিজের আবির্ভাবের পর দুজনের জুটিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা হয়েছে। কিন্তু একদিকে মুস্তাফিজ যত এগিয়েছেন, ব্যস্তানুপাতে হারিয়েছেন তাসকিন
দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে মুস্তাফিজ যখন ক্রিকেটের বিরলতম বোলারদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেখানে তাসকিন জাতীয় দল থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের পর টানা ৩৪ মাস তাসকিনকে দর্শক হিসেবে বাংলাদেশের খেলা দেখতে হয়েছে। এতে দুর্ভাগ্যও ভূমিকা রেখেছে। ওয়ানডে বিশ্বকাপে তাঁর সুযোগ না পাওয়ায় নির্বাচকদের দূরদর্শিতার অভাব ভূমিকা রেখেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্ম ফিরে পেয়ে যখন ডাক পেয়েছেন, তারপরই চোটে পড়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
গত দশ বছর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সফরকারী পেসারদের মধ্যে ওয়ানডেতে একমাত্র তাসকিন আহমেদই এক ম্যাচে স্বীকার করেছেন পাঁচ উইকেট। সেই ২০১৪ সালের ফাইফার আর এই ২০২২ এর; মাঝখানে কত কি হলো। অফ ফর্ম, ইনজুরি আবার বোলিং অ্যাকশন নিষিদ্ধ; হয়তো ক্রিকেট বিধাতা সেসময় তাসকিনের উপর নিজের সমস্ত রাগ ঢেলেছিলেন।
বারবার পুড়ে যেমন খাঁটি হয়ে উঠা যায় তেমন তাসকিনও নিজেকে পুড়িয়ে অবশেষে খাদহীন হয়ে নিয়েছেন। ফিটনেসে ব্যাপক উন্নতি আর পারফরম্যান্স দেখিয়েই ফিরেছেন জাতীয় দলে। নবাগত শরীফুল আর মুস্তাফিজুর এর সঙ্গে এক সাথে দাঁড়িয়ে লাল-সবুজের পেস ব্যাটারি তৈরি করেছেন। কিউই পাখির দেশে প্রথম টেস্ট জয় কিংবা আফ্রিকার মাটিতে প্রথম ওয়ানডেতে জয় পাওয়ার ম্যাচে সামনে থেকেই অবদান রেখেছেন এই ফাস্ট বোলার।
ধূমকেতুর মতো আগমন ছিল এরপর হারিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে এসেছেন তাসকিন। এবার তাঁর আকাশে থিতু হওয়ার পালা। এই নেভিল কার্ডাসের লেখা ক্রিকেটে উত্থান আর পতন রয়েছে। তাসকিনের পতনের সময় হয়তো শেষ, এখন শুধুই উপরে উঠার পালা। বল হাতে বাংলাদেশের পতাকাটাকে মাঠে আগলে রাখার পালা।