বাংলাদেশ দল এখন নিউজিল্যান্ডে।
সেখানে সাকিব আল হাসান নেই। বাংলাদেশে আজ সকাল থেকে ৮টি দল জাতীয় ক্রিকেট লিগ খেলছে; সেখানেও সাকিব আল হাসান নেই। সাকিব আল হাসান আপাতত ক্রিকেটের কোথাও নেই। অথচ মজাটা দেখুন, এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলোচনার একমাত্র বিষয়-সাকিব আল হাসান।
ভালো করে বললে বলা যায়, আলোচনার বিষয়-সাকিবের আলোচনা।
সম্প্রতি ক্রিকেট বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম ক্রিকফ্রেঞ্জির একটি লাইভে এসেছিলেন সাকিব। সেখানে সাম্প্রতিক নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। নিজেকে নিয়ে কথা বলেছেন। আইপিএল, টেস্ট খেলা, বোর্ডের কাজ কম্ম, এইচপি, সাংবাদিকতা; অনেক কিছু নিয়ে কথা বলেছেন। আর এসব কথা যথারীতি ক্রিকেটাঙ্গনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। যথারীতি সাকিব এখন আবার হট টপিক।
নিজের এই আলোচনার উপসর্গ হিসেবে তিনি আরেকটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন উৎপল শুভ্রকে। সেখানে নিজের কথাবার্তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
এদিকে সাকিবের এসব কথার প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যে দু একজন বোর্ড পরিচালক মুখ খুলতে শুরু করেছেন। আশঙ্কা করা যাচ্ছে, এই প্রতিক্রিয়া এখানেই শেষ হবে না। পানি আরও অনেকদূর গড়ানোর আগে আমরা বরং সাকিবের কথাগুলোর একটু মূল্যায়ন করে ফেলি।
- সভাপতি ও সুজনের প্রশংসা
যদিও সাকিব তার সর্বশেষ সাক্ষাতকারে বলেছেন, তিনি পরিকল্পনা করে এসব কথা বলেননি। ন্যায্য কথা মুখে এসেছে, তাই বলেছেন। কিন্তু বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এবং সাবেক অধিনায়ক ও গেম ডেভেলপমেন্ট চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ সুজনের যে প্রশংসা করেছেন, সেটাকে রীতিমতো নাটকীয় বলতে পারি আমরা।
সাকিব যদি এগুলো কথা পরিকল্পনা করে নাও বলেন, তাও মানতে হবে যে কথাগুলো তার জন্য অত্যন্ত ‘নিরাপদ’ হয়েছে। বোর্ডের এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দু জন ব্যক্তির প্রশংসা করায় সাকিব বড় ধরণের কোনো কোপে পড়া থেকে বেঁচে যাবেন, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
তবে সাকিবের কথার সাথে আমি একমত।
এই বোর্ডে পরিচালকদের মধ্যে সুজনই একমাত্র মানুষ, যার সক্রিয়তা চোখে পড়ার মত। বাকী বোর্ডের কার্যক্রম আসলে সভাপতিকে একাকেই দেখতে হয়। বোর্ড সভাপতিকে নিয়ে সাকিবের মূল্যায়ন যথার্থ মনে হয়েছে। নাজমুল হাসান পাপন অসাধারণ একজন ব্যবস্থাপক। বড় সংস্থা চালানোর অভ্যেস তার আগে থেকেই আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বিসিবির প্রশাসন যে তিনি ভালো চালাচ্ছেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
পাপনের সবচেয়ে বড় গুন হলো ক্রিকেটের ভালোর জন্য তিনি যে কোনো কিছু করতে রাজী আছেন। আপনি যদি এই ভদ্রলোককে নিশ্চিত করতে পারেন যে, এই কাজটা করলে ক্রিকেটের উন্নতি হবে, তিনি সেই কাজটা করতে গলা সমান পানিতে নামতেও রাজী আছেন।
- বাকী বোর্ডের সমালোচনা
এই সমালোচনাটাই সাকিবের সাক্ষাতার ও লাইভের সেরা কাজ।
একেবারে বাস্তব কথা হলো, নাজমুল হাসান পাপন ছাড়া ক্রিকেট বোর্ড একেবারেই ফাংশনাল না। কোনো একটা কমিটি নিজের উদ্যোগে কোনো একটা ভালো বা মন্দ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
একটা উদাহরণ ধরুন। এই যে আমাদের লংগার ভার্শন ক্রিকেট নিয়ে এতো কথা হয়। মূল কথাটা হয় বিসিএল, এনসিএল ও উইকেট নিয়ে। এই দায়টা নিতে হবে আমাদের টুর্নামেন্ট কমিটি ও গ্রাউন্ডস অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ কমিটিকে। আজ পর্যন্ত শুনেছেন যে, এরা লংগার ভার্শনের মান বাড়ানোর জন্য নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে সামনে এসেছে? আসেনি।
এটাও বোর্ড সভাপতিকে করতে হয়।
আমাদের জাতীয় দলের দায়িত্ব ক্রিকেট অপারেশন্সের। এই দলটার পারফরম্যান্স বাড়ানোর জন্য ক্রিকেট অপারেশন্স নিজে থেকে কিছু ভেবেছে এখনও? বোর্ড সভাপতি বললে সেটা তারা বাস্তবায়িত করে।
ফলে সাকিবের এই সমালোচনাটা সঠিক বলে রায় দেওয়া গেলো।
- টেস্ট বনাম বিশ্বকাপ প্রস্তুতি
সাকিব কেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট না খেলে আইপিএল খেলবেন?
বার্নিং প্রশ্ন যাকে বলে।
সাকিবের সহজ উত্তর হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটা আগে নির্ধারিত ছিলো না। তাই তিনি টেস্টের বদলে আগে থেকেই আইপিএল খেলবেন বলে ফ্রাঞ্চাইজিদের কথা দিয়ে রেখেছিলেন।
সেই সাথে আরেকটা পয়েন্ট হলো, সাকিবের ক্যারিয়ারের আর খুব বেশী বাকী নেই। তিনি এখন টাকার কথা বিবেচনা করছেন। এ দুটো পয়েন্ট যথেষ্ঠ ছিলো টেস্ট না খেলার জন্য।
এটা সাকিব উৎপল শুভ্রকে বলেছেনও। কিন্তু নিজের কাজটা মহিমান্বিত করতে গিয়ে বাকী যা যা বলেছেন, সেটা স্রেফ অজুহাত মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, তিনি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে আইপিএল খেলবেন।
বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ মূল পর্ব খেলাটাই নিশ্চিত না। খেলবে বাছাইপর্ব। সেই বাছাইপর্ব খেলার প্রস্তুতি নিতে সাকিবের এই ২০২১ সালে এসে আইপিএল খেলে শিখতে হবে; এটা হাস্যকর কথা। আমি নিশ্চিত, এটা সাকিব নিজেও বিশ্বাস করে বলেননি। এটা স্রেফ ফেসবুকে ভক্তদের যুক্তি দেখে তৈরী হওয়া একটা কু যুক্তি।
- জাতীয় দলের পাইপলাইন
এটা সত্যিই হতাশার জায়গা।
সাকিবের এই হতাশাটাকে আমরা কেবল শ্রদ্ধা করতে পারি। গত এক দেড় দশকে পাইপ লাইনে ঢোকার জন্য ক্রিকেটার কম আসেনি। প্রতিটা যুব বিশ্বকাপ থেকে এক ঝাক করে ক্রিকেটার এইচপিতে এসেছে। তারা প্রায় রেডিই ছিলো। কিন্তু তাদের নিয়ে কী হয়েছে?
কত ঢাক ঢোল পিটিয়ে একেক বার এইচপি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু কার্যত এইসব যুব ক্রিকেটাররা হারিয়ে গেছে। উপরন্তু জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া ক্রিকেটারদেরও যত্ন নিয়ে এইচপি আবার জাতীয় দলে ফেরত পাঠাতে পারেনি।
হ্যা, এবারের বিশ্বকাপজয়ী দলটাকে নিয়ে তারা কিছু কাজ করছেন। কিন্তু সেটা যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। স্রেফ একাডেমিতে রেখে কিছু ম্যাচ খেলানোই যথেষ্ট কাজ হতে পারে না। তাদের নিবিঢ় প্রশিক্ষন, যথেষ্ট সফর করানো এবং সঠিক প্রস্তুতির মধ্যে রাখাটা জরুরী।
হ্যা, নাঈমুর রহমান দূর্জয় হয়তো এই কথাগুলো শুনে মন খারাপ করেছেন। কিন্তু তাকে বুঝতে হবে, এই কথাগুলো তার বিপক্ষে নয়; এইচপি কাঠামোর বিপক্ষে। তিনি আসার পর থেকে এইচপি তো কিছু কাজ করছে। বছরের পর বছর যে কাজ হচ্ছিলো না, সাকিব সেটাই বলেছেন। এখন আকবর আলীরা এখান থেকে যোগ্য হয়ে বেরোলো তো সাকিব নিশ্চয়ই দূর্জয়ের প্রশংসা করবেন।
- সাকিব সেরা বিসিবি সভাপতি হবেন
আমার চিরকালের দুঃখ, এই দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, জ্ঞানবুদ্ধিওয়ালা লোকেরাও সাকিবের কথা ধরতে পারেন না।
আমি নিশ্চিত, এটা সাকিবের আরেকটা হিউমার।
হ্যা, সাকিব খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেটে থাকলে সভাপতি তো হতেই পারেন। হলে ভালো সভাপতিই হবেন। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই তিনি এখনই সভাপতি হওয়ার জন্য বলেননি। ফলে এই কথাটা নিয়ে এতো আলোচনার সুযোগ নেই।
- সাংবাদিকতা নিয়ে একটু
সাকিব বলেছেন, ক্রীড়াসাংবাদিকরা তাদের কাজটা ঠিকমতো করছেন না।
প্রথমত আমি এটার সাথে একমত। একটা সমাজ যেমন হবে, সেখানকার ক্রিকেটার, সাংবাদিক, পুলিশ, ডাক্তার; সবই তেমন হবে। এক জন সাকিব ব্যতিক্রম। সবাই সাকিব হতে পারে না। তাই আমরা ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবেই সবাই সাকিবের মানের নই; সাধারণ। ফলে আমরা গভীরে গিয়ে কিছু আলাপ করার চেয়ে বিয়ে, বাচ্চা, নাসির, এসব বিষয় নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকি।
তবে সাকিব যেভাবে অভিযোগ করেছেন যে, বড় বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না, এটা পুরোপুরি সত্যি না। তিনি সম্ভবত সব লেখা পড়ার সুযোগ পান না। আমাদের ছোট্ট এই খেলা ৭১। এই কয়েক মাস বয়সী প্লাটফর্মেও আমরা বারবার আমাদের প্রথম শ্রেনীর কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। ম্যাচ পাতানো নিয়ে বড় একটা পত্রিকা গত বছরও বিরাট এক পাতার আয়োজন করেছে। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
তারপরও সাকিবের সাথে একমত যে, আমরা সাংবাদিকরাও গড় পড়তা।