২৬ বছর, ৪৫ টি টেস্ট।
হ্যাঁ, টেস্টের প্রথম জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ড দলকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২৬ বছর, খেলতে হয়েছিল ৪৫ টি টেস্ট।
নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের একেবারে শুরু থেকেই দলটা প্রচণ্ড আন্ডাররেটেড, প্রচণ্ড আন্ডারডগ। অথচ, গেল দু’টো বিশ্বকাপের দু’টোতেই শিরোপা যুদ্ধের অন্তিম লড়াইয়ের ম্যাঠে ঠাই হয় ব্ল্যাক ক্যাপদের।
২০১৫ সালে তাঁদের কেউ পাত্তাই দেয়নি ফাইনালে। ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দলও অস্ট্রেলিয়াকে সামনে চোখ রাঙিয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
২০১৯ সালেও তাঁদের ফাইনাল জয়ের আলোচনায় নাম ছিল সামান্যই। কিন্তু, এবার কেন উইলিয়ামসনের দল চোখ রাঙাতে পেরেছিল। পেরেছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে। তা না হলে কি লর্ডসের সেই লড়াইটা সুপার ওভারে গড়ায়!
আসলে গড়ায় না, যদি ভুতুড়ে এক ওভার থ্রো হয় শেষ ওভারে। কিংবা গড়ালেও আইসিসির ভুতুড়ে এক নিয়মে সুপার ওভারে সমতা থাকার পরও ট্রফি যায় ইংল্যান্ডের হাতে। ম্যাচটায় কার্যত ইংল্যান্ড জিততে পারেনি, স্রেফ নিয়মের মারপ্যাচে জিতে যায় ট্রফিটা।
সেদিনের কেন উইলিয়ামসনের ফ্যাকাশে সেই হাসি লেখা হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। এ যেন সেই ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের লিওনেল মেসি, কিংবা ২০০৬ বিশ্বকাপের জিদেদিন জিদান, বা ১৯৯৮ সালের প্যারিস ফাইনালের ম্লান তারকা ব্রাজিলের রোনালদো।
কিন্তু, নিপাট ভদ্রলোক খ্যাত কেন উইলিয়ামসন অন্য ধাঁতুতে গড়া। তিনি বিষাদমাখা বিউগলটাকে সাফল্যের ঝঙ্কারে পরিণত করতে জানেন। আর হলও তাই, বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার শঙ্কায় থাকা সাউদাম্পটনের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে আসল টেম্পারমেন্ট দেখালেন তিনি।
প্রথম ইনিংসে ৪৯ রানের ইনিংস, দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২ রানের অপরাজিত ইনিংস। ম্যাচ শেষে যতই ম্যাচ সেরার পুরস্কার তরুণ বিশালদেহী পেসার কাইল জেমিসনের হাতে উঠুক না কেন – ম্যাচের সত্যিকারের নায়ক তো এই অধিনায়কই। ঠাণ্ডা মেজাজে ম্যাচটা বের করে আনাটা তাঁর থেকে ভাল আর কেই বা জানে!
শুধু ম্যাচ না, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে সত্যিকারের আলোর পথটা এই উইলিয়ামসনই চিনিয়েছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির দিনে দলকে দেখেছেন বাংলাদেশের মাটিতে সিরিজ হারতে, ২০১০ সালে। সেখান থেকে তিনি একটু একটু করে বড় হয়েছেন, একটু একটু করে পরিণত হয়েছেন।
ম্যাককালাম যে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার স্টাইলটা নিউজিল্যান্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, সেই স্টাইলটা নিয়ে আরো কাজ করেছেন। দলটায় পরিবর্তন এনেছেন আরো, নিজে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি দলটাকে আরো পরিণত করতে পেরেছেন। তারই প্রমাণ মিলেছে এবারের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে।
ইতিহাস ক্লাইভ লয়েডকে মনে রেখেছে, মনে রেখেছে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। অধিনায়ক হিসেবে তাঁরা সর্বকালের সেরাদের কাতারে। সেই তালিকায় এবার যোগ হয়ে গেল কেন উইলিয়ামসনের নামও। টেস্টের প্রথম বিশ্ব শিরোপা তাঁরই হাতে।
তিনি নীরব এক কবি, তাঁর মাথার ভিতরেই সব চলে। খালি চোখে অধিনায়ক হিসেবে তাঁর কোনো বাড়তি কারিশমা বা ‘এক্স ফ্যাক্টর’ নেই। তবে, তিনি দলটাকে গড়তে জানেন। শিল্পী যেমন তাঁর তুলি নিয়ে কোনো চিত্রকর্মকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন, কেন উইলিয়ামসনও তাই। শিল্পীকে বোঝা কঠিন, কেন উইলিয়ামসনও তাই। তবে, তাঁর শিল্পটা প্রচণ্ড স্পষ্ট, প্রচণ্ড রঙিন।
তাঁর মধ্যে আবেগের প্রকাশ ঘটে সামান্যই। রস টেলর যখন তাঁর সিগনেচার ফ্লিক শটে বলটাকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে বিশ্বজয় নিশ্চিত করলেন, অপর প্রান্তে থাকা কেন উইলিয়ামসন তখন নীরব, শান্ত। যতই ড্রেসিংরুমে উৎসব বয়ে যাক না কেন, তিনি খুব স্বাভাবিক। যেন অফিসের আর ১০ টা সাধারণ দিন, যেন আর ১০ টা সাধারণ ম্যাচ জয়। যেন শান্ত একটা নদী, যার কাজ স্রেফ বয়ে চলা – কোনো প্রতিদানের আশা না করেই।
তবে, প্রকৃতি কখনো কখনো সেই প্রতিদানটা দিয়ে যেন। তাই তো শান্ত নদীর হাতে আজকে শ্রেষ্ঠত্বের দণ্ড। এবার কেনের ঠোঁটের কোণের হাসিটাও চওড়া – তাতে কোনো ফ্যাকাশে ভাব নেই। দুই বছর আগের ম্লান হাসিটা আর বেশ ঝলমলে, অনেক বেশি উজ্জ্বল। শান্ত নদীও হাসতে জানে প্রাণ খুলে, কাঁদাতে জানে, হাসাতেও জানে।