আলজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে ভিটেমাটি ছেড়ে যখন স্মইল আর মালিকা চলে এলেন মার্শেইতে তখন ছোট্ট জিজৌ-এর জন্ম হয় নি। দক্ষিন ফ্রান্সের মার্সিলি শহর।উদবাস্তু ভিড়ে ঠাসা, অনেকটা পার্টিশনের পরে কলকাতা শহরের রিফিউজি কলোনির মতোই।
স্মইলের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কেয়ারটেকারের চাকরির অনটনের মাঝেই জন্ম হল জিদানের, এলাকার বাকি ছেলেদের সাথে বড় হতে হতে জিনেদিন জিদান বুঝেছিল ও ভাগ্যবান, এলাকার ভয়ংকর দারিদ্র্যের পাশে দুবেলা দুমুঠো খাবার, মাথার ওপর ছাদ- সবটাই ছিল ওর।
৮০ গজ বাই ১২ গজের একটা পরিত্যক্ত ফরাসি ক্যাসেলের ভেতর নিজেদের ফুটবল খেলা চালিয়ে যেত জিদান আর ওর বন্ধুরা, খেলা শেষে জিদান নিজের খাবার থেকে ভাগ করে খাইয়ে দিত বন্ধুদের, জিদান জানত ভালবাসা ছড়িয়ে দিলে তা কেমন করে যেন দ্বিগুন হয়ে ফিরে আসে।
পায়ে ফুটবলের যাদু শুরুর আগেই আসতে আসতে মার্সেই শহরের বুকে জিদান বদলে দিতে থাকল অনেককিছু, এলাকার চুরি-পকেটমারি করা বন্ধুদের ও নিয়ে আসতে পেরেছিল সঠিক পথে ঠিক যেরকম একটা বাউন্স খাওয়া বলকে ইনস্টেপের কায়দায় রিসিভ করে চকিতে টার্ন নিয়ে ফুটবলের সিলভার লাইন খুলে দিতেন বলটার জন্য- ঠিক সেইভাবে।
জিদানের জুতোজোড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল অনেকদিন, বাবার কাছে নতুন জুতোর কথা বলার সাধ্য ছিল না ছেলেটার কিন্তু জিদান জানতেন কলোনির অনেক ছেলের পা দুটোই নেই ! এই বোধটা ঘুম কেড়ে নিল এক জিজৌর, শুরু হল ফুটবল পায়ে দিইয়ে সোনালি দৌড়।
মাঝমাঠে জিদানের পায়ে বল পড়লেই জেগে উঠত তুরিন থেকে স্যান্তিয়াগো বার্নাব্যু, জিদানের প্রতিটা কোমরের মোচরে ভেঙে যেত ‘রিফিউজি, রিফিউজি’ বলে বিদ্রুপ করা সমাজের একটা অন্ধকার দিক, জিদানের বুকে জমে থাকা সবুজ প্রাণ গোলাপ হয়ে ফুটে উঠত সবুজ গালিচায়, জিদানের শান্ত অথচ মন্দ্রিত প্রলয় নৃত্যে ২০০৬ কোয়ার্টার ফাইনালে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল ফুটবলের এক সাম্রাজ্য।
১৯৯৬ সালে ২৪ বছরের জিদানের মাঝমাঠের জাদুতে তুরিণে যখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ এল তখন বোধহয় সারাবিশ্ব দেখেছিল ভিনসেন্ট ভ্যান গফের ‘দ্য স্ট্যারি নাইট’ ছবির মতোই দক্ষিণ ফ্রান্সের অন্ধকার আকাশে একটা একটা করে তারা হয়ে ফুটছে জিদানের প্রতিটা মুভ।
কিন্তু মাতেরাজ্জি কী বলেছিলেন সেদিন? তার উত্তর জানা নেই তবে সেই ফাইনাল ছিল প্রলয় নাচের পর নটরাজের জটার বাঁধন খুলে পড়ার ক্ষণকাল, শান্ত নিরীহ নটরাজ সেদিন যেন ফুটবলের আপন স্রোতে আপনি মেতে জার্মানির আকাশে মেলে দিয়েছিলেন ফুটবলের অনন্ত নির্যাস। সেখানে মাতেরাৎজির কটুক্তি বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করেছিল নটরাজের বিরহী রূপ, কিন্তু মহাপ্রলয়ের পর যেমন নটরাজ ধ্বংসাবশেষ দেখে কাঁদেন, জিজুও হয়ত কাঁদেন, আজও কাঁদেন যখন দেখেন ফরাসি ট্রফি ক্যাবিনেটে রাখা বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফিটা।
যে লোকটা হাজারে হাজারে গরীব বাচ্চার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন, যে লোকটা ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেন নিজের অর্থ, নিজের উদ্যোগে চ্যারিটি ম্যাচ করে তুলে দেন শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাঁর সৃষ্টির বামহস্তের ছোঁয়া ফুটবল পাচ্ছে আজীবন, ফুটবলের নটরাজের প্রলয় নাচন দেখে মনে হয় কোন একটা দিন নয়, প্রতিদিন যখন কেউ সবুজ গালিচায় নামে ফুটবল নিয়ে সেদিনই নতুন করে জন্ম হয় একজন জিদানের, এই সবুজ গালিচাদের হাজার হাজার জিনেদিন জিদানদের নটরাজ হয়ে ওঠার স্বর্গলোক, রবিঠাকুর লিখেছিলেন ‘সব-হারা সে সব পেল তার কূলে কূলে’- এভাবেই যে অনন্ত সবুজ পৃথিবীর মাঝে সমস্ত কিছু ভালবাসার হরফে ফিরিয়ে দিতে জন্ম হয় জিনেদিন জিদানদের।