একটা ছোট গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। টেনিসের গল্প আর ফেদেরার থাকবেন না, এটা অনেকটা গরম মশলা ছাড়া মাংসের মত, অগত্যা। ২০১৬ সালের উইম্বলডন চলছে। সেই সময়ে ঘাসের কোর্টে ফেদেরার চরম ফর্মে। পরপর দুবার ফাইনাল খেলেছেন, জোকোভিচ কে হারাতে না পারলেও ২০১৬ তে জোকোভিচ আগেই হেরে গেছেন।
অ্যান্ডি মারে ছাড়া বড় নাম কেউ আর টিকে নেই। কোয়ার্টার ফাইনালে ফেডেরার একটা অমর ম্যাচ খেললেন চিলিচের বিরুদ্ধে। প্রথম দু সেট হেরে গিয়ে ফিরে এলেন, চতুর্থ সেটে আবার চিলিচ তিনটি ম্যাচ পয়েন্ট পেলেন টাই ব্রেকারে, কিন্তু তাও ফেডেরারের রক্ষণ ভাঙতে পারলেন না। পঞ্চম সেটে ফেডেরার চিলিচকে সুযোগ না দিয়ে ৬-৩ জিতে সেমিফাইনালে উঠলেন।
গোটা টেনিস দুনিয়া যখন ধরে নিয়েছে এবারে ট্রফিটা ফেডেক্স এর হাতেই উঠছে, এবং এর চেয়ে নাটকীয় কিছু অন্তত এই টুর্নামেন্টে সম্ভব না, তখনই এলো পরের ম্যাচ, সেমিফাইনাল, রাওনিচের বিরুদ্ধে। মিলোস রাওনিচ সেই সময়ে টেনিস দুনিয়ায় এক পরিচিত নাম, বেশ কিছু টুর্নামেন্ট তিনি জিতেছেন, কিন্তু উইম্বলডনে সেন্টার কোর্টে তিনি ফেডেরারকে হারাবেন, এটা মনে হয় কেউ কল্পনা করেননি।
কিন্তু অদ্ভুত অলৌকিক একটা ব্যাপার সেদিন ঘটে গেলো। প্রথম সেট হারলেও, পরের দুই সেট জিতে ফেডেরার ম্যাচ জয়ের দিকে দোরগোড়ায়, চতুর্থ সেটে তুল্যমূল্য লড়াইয়ের পরে ফেডেরার যখন ৫-৬, ৪০-০ অবস্থায় টাইব্রেকার এর দিকে এগোচ্ছেন, তখন হঠাৎ রাওনিচ দুরন্ত রিটার্ন ও রালি করে ডিউস করেন এবং তৃতীয় সেট পয়েন্টে ফেডেরার সহজ ক্রসকোর্ট উইনার না মেরে রাওনিচের মুভমেন্ট ভুল প্রেডিক্ট করে সোজা মারেন এবং নেটে এগিয়ে আসা ফেডেরারের পাশ দিয়ে পাসিং উইনার মেরে রাওনিচ্ চতুর্থ সেট জিতে নেন।
পঞ্চম সেটে ফেদেরারের সেই বহু আলোচিত পতন, হাঁটুর চোট, প্রথমবার উইম্বলডন সেমিফাইনাল হার এবং ছয় মাসের জন্যে কোর্টের বাইরে চলে যাওয়া। পরে ফেডেরার ম্যাচ হারার জন্যে নিজেকে দায়ী করেন এবং বলেন চতুর্থ সেটে তিনি রাওনিচকে ম্যাচে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অনেকেই এটাকে ফেডেরারের ঔদ্ধত্য মনে করলেও, বোঝা গেছিল এই হার তিনি ভালোভাবে নেননি।
ম্যাচ জয়ের পরে চোটগ্রস্ত ফেদেরারের সামনে রাওনিচের উল্লাস হয়তো তাঁকে আরো তাতিয়ে দিয়ে থাকবে। এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। ২০১৭ সালে চোট সারিয়ে এপিক কামব্যাক করেন ফেডেরার, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ও উইম্বলডন জেতেন। ২০১৭ উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি আবার মুখোমুখি হন রাওনিচের এবং ৬-৪, ৬-২, ৭-৬(৪) ফলে স্ট্রেট সেটে স্রেফ উড়িয়ে দেন রাওনিচকে।
কমেন্টেটররা আলোচনা করছিলেন যে আগের বছরের হারের ক্ষত এখনও ফেডেরারের মধ্যে রয়েছে, যেভাবে তিনি চূড়ান্ত আগ্রাসী ভঙ্গিমায় শটগুলো খেলছিলেন অতিরিক্ত এনার্জি নিয়ে, তাতে সেটাই প্রমাণ হয়। ম্যাচ জয়ের পরে ফেডেরারের উল্লাস কোয়ার্টার ফাইনাল জয়ের সঙ্গে তুলনীয় ছিলনা। বরং তিনি যেনো রাওনিচকে বলছিলেন – Get off my lawn!
জিনিয়াসরা এরকমই হন। তাঁরা প্রতিটি হারের হিসেব রাখেন, বদলা নিতে চান। গতকাল ফ্রেঞ্চ ওপেনের মহাকাব্যিক কোয়ার্টার ফাইনালে রাফা নাদালের খেলা দেখে ঠিক এই কথাই মনে হচ্ছিল। ফেদেরারের ঘাসের মতোই, তিনি হচ্ছেন ক্লে এবং ফ্রেঞ্চ ওপেনের একচ্ছত্র অধিপতি। বরং কিছু বেশি।
কেননা ১৩ বার একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম পুরুষদের সিঙ্গলসে কেউ কোনোদিন জেতেননি। ২০২০ ফাইনালে তিনি জোকার কে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিলেন ৬-০, ৬-২, ৭-৫ ফলে। কিন্তু ২০২১ এ বদলা নেন জোকোভিচ। প্রথম সেটে প্রায় উড়ে গিয়েও দারুণভাবে ফিরে এসে ৪ সেটে হারিয়ে দেন নাদালকে সেমিফাইনালে।
ট্রফি ও জেতেন তিনিই। এরপরে অনেক বিশেষজ্ঞ নাদালের পতনের শুরু ভেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু সবাইকে আবার ভুল প্রমাণ করে নাদাল ২০২২ এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে নিজেকে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লামের মালিক হিসেবে এককভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তবুও, গতবারের সেমিফাইনাল হারের বদলা নেওয়া কিন্তু বাকি ছিল।
কালকে নাদাল শুরু করলেন অবিশ্বাস্য মানের টেনিস দিয়ে। প্রথম সেটে ভুল প্রায় করছিলেন না। অন্যদিকে জোকোভিচ ছিলেন অনেকটাই নিষ্প্রভ। ৬-২ ফলে নাদাল প্রথম সেট জেতার পরেও অবশ্য ম্যাচের ফলাফলের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, কেননা জোকোভিচের কঠিন ম্যাচ বার করার স্ট্র্যাটেজি বা ট্যাকটিকস থাকে প্রথমদিকে বিপক্ষকে খেলতে দাও, তারপরে বিপক্ষ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন খালি সব বল অবিশ্বাস্য ফিটনেস দেখিয়ে কোর্টের ওপারে পাঠিয়ে বিপক্ষকে আনফর্সড এরর করতে বাধ্য করো।
এইভাবেই ২০১৯ সালের উইম্বলডন ফাইনালে ফেডেরারের থেকে কম ব্রেক পয়েন্ট জিতে, মোট পয়েন্ট কম জিতে, কম উইনার মেরেও তিনি ট্রফিটা বাগিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সেটে নোভাক ব্রেক করেন নাদালকে। এবং একেকটা গেম চলতে থাকে ১৮ মিনিট, ২০ মিনিট ধরে, সাধারণত অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফেদেরার উইম্বলডনে এই সময়ে গোটা সেট জিতে ফেলেন!
অবশেষে ৮৮ মিনিটের ম্যারাথন লড়াইয়ের পরে ৬-৪ ফলে দ্বিতীয় সেট জিতে ম্যাচে সমতা ফেরান জোকোভিচ, আর দর্শকরা চিরপরিচিত চিত্রনাট্য আবার দেখতে চলেছেন বলে ভাবতে শুরু করেন। দ্বিতীয় সেটে দুই মহারথীর খেলা এত উচ্চ মানে পৌঁছায় যে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন মোহাম্মদ আলী আর জর্জ ফোরম্যান লড়ছেন রিংয়ে, আর একে অপরকে একের পর এক পাঞ্চ মারছেন।
একদিকে যেমন নাদাল দুরন্ত সব ড্রপ শট, ওভারহেড স্ম্যাশ এবং যেকোনো সামান্য শর্ট বলে উইনার মেরে জোকোভিচকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিলেন, জোকোভিচ আবার দুরন্ত ডিফেন্স, আর তার সাথে অসাধারণ সব উইনার মারছিলেন একদম সাইডলাইন ঘেঁসে, কেননা তার থেকে একটু কম হলেই নাদাল সেটাকে ফেরত পাঠাবেন, এবং নাদাল যে মানের টেনিস কালকে খেলছিলেন, তাতে তাকে বেশি বলের কাছে পৌঁছতে দেওয়া মানেই নিজের হার নিশ্চিত করা।
কিন্তু তৃতীয় সেটে আবার নাদাল প্রথম সেটের মত ভুলবিহীন এবং আক্রমণাত্মক টেনিস শুরু করেন, জোকোভিচ কে থই পেতে না দিয়ে, এবং ৬-২ ফলে আবারও এই সেট জিতে নেন। চতুর্থ সেটে আবার জোকোভিচ ৩-০ এগিয়ে যান, এবং যখন মনে হচ্ছে নাদাল এবারে ক্লান্ত, এবং নিজের পরিচিত চিত্রনাট্য পরিচালনা করে ম্যাচ পঞ্চম সেটে নিয়ে গিয়ে নাদালকে পেড়ে ফেলবেন জোকোভিচ, তখনই নাদালের দুরন্ত কামব্যাক, এবং ২-৫ পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে টাইব্রেকারে নিয়ে গিয়ে জকোভিচকে স্রেফ ধ্বংস করে দেওয়া।
শেষের দিকে জোকারের মুখে অবিশ্বাসের ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, বিশ্বের এক নম্বর বাছাই টেনিস প্লেয়ার হয়েও এই হার তাঁকে কতটা অবাক করে দিয়েছে! নাদালের খেলা দেখে কমেনটেটররা বলতে বাধ্য হন যে ২০১৩ সালের নাদাল যেনো ফিরে এসেছেন। অবিশ্বাস্য সব উইনার, তার সাথে খুবই কম আনফর্সড এরর। বিশেষ করে ডাউন দা লাইন ফোরহ্যান্ড উইনার আর ক্রসকোর্ট ব্যাকহ্যান্ড উইনার যা মেরেছেন, ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মত।
তার সাথে প্রায় কোনো স্ম্যাশ না মিস করা, এবং জোকোভিচের অধিকাংশ শটের গতিপথ আগে থেকেই অনুমান করে সুবিধাজনক জায়গায় পজিশন নেওয়ার ফলে জোকোভিচ প্রায় কিছুই করতে পারেননি। অবশ্য এঁরা দুজন কালকে খেললেন তাঁদের মধ্যে ৫৯ তম ম্যাচ। সার্কিটে সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা। একে অপরকে ভালই চেনেন। খেলার স্টাইল, কৌশল জানেন।
তবে কালকে দিনটা ছিল নাদালের। আর জোকোভিচকে হারিয়ে তিনি যেনো হুংকার দিলেন – Get off my drawing room! হ্যাঁ, ফিলিপ শাতিয়ার কোর্টটা নাদালের ড্রইং রুমই বটে। আর তাঁর একচ্ছত্র সম্রাট তিনিই, প্রমাণ করে দিলেন আরো একবার।