১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মের এক সকালে বাবা নিয়ে গেলেন সুভাষ সরোবরে, ৩৬ নং বাসে করে। সাদা টি শার্ট, ট্রাউজার আর রবার স্টাডসের সাদা বাটার পাওয়ার শ্যু। ক্রিকেট কোচিং সেন্টার। ইস্ট ক্যালকাটা ডিসট্রিক্ট স্পোর্টস ফেডারেশনের এক বিশাল মাঠের এক প্রান্তে সিমেন্টের দুটো হাফ পিচ আর রানআপ আর ফলোথ্রু সুরকি দিয়ে গড়া। লাইন দিয়ে দাঁড়ালাম।
প্রথমে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং ফেডারেশনের কর্ণধার মন্টু স্যান্যাল আর তাঁর সঙ্গেই এক সম্পূর্ণ পলিত কেশ ব্যাকব্রাশ করা পেল্লাই এক সাদা গোঁফ পাকিয়ে দুদিকে ওঠানো, চোখে অ্যাভিয়েটর। সাদা শার্ট হাতা গোটানো কনুইয়ের উপরে, সাদা ট্রাউজার। তদানীন্তন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীও এলেন। সঙ্গে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। ফিতে কাটা হল। দুজনেই গ্লাভস পরে ব্যাট হাতে দাঁড়ালেন, একে একে সিমেন্টের উপর নতুন গাঢ় সবুজ ম্যাটের উপর।
ফটো অপের জন্য অপেক্ষামান ছেলে-ছোকরারা বা জনগণ নেটের পিছনটা ঘিরে ফিলেছেন। সাংবাদিকরা ফটোগ্রাফাররা মিড অফ, মিড অন বা কল্পিত শর্ট কভারে। সেই পলিত কেশ বৃদ্ধের হাতে বল তুলে দিল কে যেন একটা দু’কদম দৌড়ে বোলিং ক্রিজের পাশে এসে হালকা করে ভাসিয়ে দিলেন, মন্ত্রী বলে কথা। পায়ে লেগে গেলে? তবুও সুভাষ চক্রবর্তী মিস করলেন, বলটা উইকেট নাড়িয়ে দিতে বললেন, ‘না না এভাবে নয়!’ হাফ পিচের সামনে এসে ছুঁড়ে দেওয়া হল। ব্যাট দিয়ে খেললেন। অসীম দাসগুপ্ত অবশ্য ভালোই ব্যাট ধরলেন।
আর আমরা? তখন সদ্য কৈশোরের কোটায়, পাশাপাশি যারা আছে রণিত, সম্বিত, পিনাকীদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। তারপর দেখলাম বাবাকেও বলা হল, ‘অতীন দা আপনিও আসুন!’ ছবি তোলা হল। জিজ্ঞাসা করে জানলাম সেই পক্ব কেশ ঋজু আর্মি কর্ণেলের মতো দেখতে ভদ্রলোকের নাম মন্টু ভট্টাচার্য। ভারতের হয়ে নাকি টেস্ট খেলেছেন। কবে? সেটা বলার জন্যই এই জার্নি।
১৯৪২ ভারতবর্ষ উত্তাল আরপারের লড়াইয়ের কারণে। ইউরোপ উত্তাল এক বিকৃত মানসিকতার রাষ্ট্রনায়কের বিশ্ববিজয়ের দু:স্বপ্নের কারণে। বেলেঘাটার ত্রিকোণ পার্কের সুঁড়া স্পোর্টিং ক্লাবের আশেপাশেই অবিনাশ ব্যানার্জীর নামে রাস্তা। বড় ছেলে হিমাংশু ব্যানার্জি বডিবিল্ডিং-এ জাতীয় স্তরে অংশ নেন। কিন্তু মেজো ছেলে সুধাংশু শেখর ব্যানার্জি ওই ১৯৪২-৪৩-এই স্পোর্টিং ইউনিয়ন খেলতে খেলতে বাংলা দলে জায়গা করে নিলেন। ৫ ফুট এগারোর সুঠাম ঋজু অ্যাথলেটিক শরীর। মূলত ইনস্যুইং লেগকাট বোলার।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আউট স্যুইংটাও শিখে নিয়েছেন। খেলা শেখেন ১৯৩৮-৩৯’এর রঞ্জি জয়ী বাংলা দলের স্টার ব্যাটসম্যান শ্রদ্ধেয় কার্তিক বোসের কাছে। কার্তিক বোসই হাতে ধরে সিম সোজা রাখতে শিখিয়েছেন, এবং ফলত ভারত স্বাধীন হতে হতে পুরনো বলও কথা বলতে শুরু করেছে সুধাংশু ব্যানার্জির। অবশ্য ময়দান তদ্দিনে তাঁকে মন্টু নামেই চেনে। সুধাংশু শেখর তো শুধু রেকর্ডের খাতায়।
অবশ্য সেখানেও গল্প আছে। আমরা যখন আজকের দিনে বাংলার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলির মধ্যনাম বাবার নামে দেখে চমৎকৃত হই, আজ থেকে সেই পঁচাত্তর বছর আগেই সুধাংশু শেখর, নিজের মধ্যনাম বাবার নাম ব্যবহার করতেন। সুধাংশু অবিনাশ ব্যানার্জি।
১৯৪২-৪৩এ রঞ্জি দলের হয়ে খেলা শুরু করলেও প্রথম খবরে আসেন পরের বছর। মাদ্রাজের বিরুদ্ধে (তখনও তামিলনাড়ু হয়নি) দুই ইনিংস মিলিয়ে ৭৯ রানে ৭ উইকেট তুলে। তবু ১৯৪৬এর ইংল্যন্ড সফর বা ১৯৪৭-৪৮এর স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে অস্ট্রেলিয়া সফরে জায়গা হয়নি মন্টু ব্যানার্জির।
নজরে এলেন তারকাখচিত হোলকারের বিরুদ্ধে ইডেনে দশ উইকেট নিয়ে। কে ছিল না তাঁর শিকার, সিকে নাইডু, সিএস নাইডু, মুশতাক আলী, হিরালাল গায়কোয়াড়। তখন অবশ্য ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়ায়। পরবর্তী আন্তর্জাতিক সিরিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দেশে। শিকে ছিঁড়ল যখন বোম্বেতে পশ্চিম অঞ্চলের বিরুদ্ধে ৭ উইকেট পেলেন। এবারে শিকার বিজয় হাজারে, পলি উম্রিগড়, হেমু অধিকারী প্রমুখ।
তদ্দিনে অবশ্য দুটি টেস্ট খেলা হয়ে গেছে সিরিজের। তৃতীয় টেস্ট কলকাতায়, ইডেন গার্ডেন্সে। বর্তমান ইডেনের মতো চারদিক ঘেরা স্টেডিয়াম ছিল না তখন। বছরের শেষ দিনের ফুরফুরে হাওয়াযুক্ত আবহাওয়ায় ডেনিস অ্যাটকিনসন, অ্যালান রে, ক্লাইড ওয়ালকট, এভার্টন উইকস, গ্যারি গোমেজ, জর্জ ক্যারুর শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের উপর ভরসা করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক জন গডার্ড ব্যাটিং নিলেন। অমরনাথ নিজে শুরু না করে বল তুলে দিলেন মন্টু ব্যানার্জির হাতে।
৫ ফুট ১১’র মন্টু ব্যানার্জি, দৌড় শুরু করলেন প্যাভিলিয়ন প্রান্ত থেকে। মোটামুটি গতি এবং হাতে স্যুইং। দুটো বল ছেড়ে দিয়ে তার পরের দুটো ইন স্যুইং ব্যাট দিয়ে ডিফেন্স করলেন অ্যাটকিনসন। প্রথম ওভারের পঞ্চম বল, মন্টু ব্যানার্জি ছুটে এলেন আর হাত থেকে বেরোল লুকনো ব্রহ্মাস্ত্র! লেগ কাটার। রিটার্ন ক্রিজ বরাবর বলটা নিয়ে ছাড়লেন কোণাকুণি।
অ্যাটকিনসন কোণ বুঝে ডিফেন্স পাতলেন, কিন্তু বল পিচ পরার পর ব্যাট এড়িয়ে অফস্টাম্প উড়িয়ে দিল। দু’হাত তুলে ছুটে গেলেন মন্টু উইকেট কিপার প্রবীর সেনের দিকে। দর্শক আসন থেকে পাড়ার লোকরা তখন অপরিচিতদের চিনিয়ে দিচ্ছে, ‘এই দেখুন। এর নাম মন্টু ব্যানার্জি। একে দেখে রাখুন। বাংলার দ্বিতীয় টেস্ট খেলোয়াড়!’
পাঁচ ওভার পরে মন্টু ব্যানার্জির ইনস্যুইং পেয়ে গেল অপর ওপেনার অ্যালান রে’র সামনের পা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮ রানে ২। এরপর অবশ্য ওয়ালকট ও উইকস সামলে নিলেন। কিন্তু শতরানের পার্টনারশিপ হবার আগেই গুলাম আহমেদের সামান্য খাটো লেন্থের বল পুল করলেন ওয়ালকট। শর্ট মিড উইকেটে মন্টু ব্যানার্জি ঝাঁপালেন।
আর উঠে এলেন আবার দু’ হাত তুলে গুলাম আহমেদ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন মন্টু ব্যানার্জিকে। জীবনের প্রথম টেস্ট উইকেটের সিংহভাগ কৃতিত্ব তো ওই বুলেটকে দুহাতে ধরে ফেলা মন্টু ব্যানার্জিরই। মন্টু আরও দুটি উইকেট পেলেন সেই ইনিংস-এ, গুলাম আহমেদও তাঁর প্রথম টেস্ট ইনিংসে ৪ উইকেট পেলেন।
ব্যাট করতে নেমে অবশ্য দুজনেই ফার্গুসনের বলে স্টাম্পড হলেন শূন্য রানে। তবু যেন দুই অভিষেককারীর ভবিতব্য লেখা থাকল দুই ভিন্ন হিসাবের খাতায়। গুলাম আহমেদ পরবর্তীকালে ভিনু মানকড় এবং সুভাষ গুপ্তের সঙ্গে ভারতের প্রথম স্পিন ত্রিভূজ তৈরি করলেন। আর মন্টু ব্যানার্জি? সেই টেস্টে পাঁচ উইকেট আর তিনটে ক্যাচ নেবার পরেও। পরের টেস্টে জায়গায় খোয়ালেন তৃতীয় বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটারের কাছে। নীরদ পুটু চৌধুরী পরের চেন্নাই টেস্টে মন্টু ব্যানার্জির স্থলাভিষিক্ত হলেন। এবং পরের টেস্টে আটত্রিশ বছর বয়স্ক চতুর্থ বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার শরদিন্দু ব্যানার্জির কাছে জায়গা খোয়ালেন।
ইডেন টেস্টের পঞ্চম দিনে যখন সকলে জানতে পারলেন যে ভাল বল করা সত্ত্বেও মন্টু ব্যানার্জি পরের টেস্টে টিমে নেই, তখন এভার্টন উইকস মজা করে বললেন, ‘তুমি ইন্ডিয়ান আর আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। আমাদের হয়ে খেলো পরের টেস্ট!’
কিন্তু আর টেস্ট খেলা হয়নি মন্টু ব্যানার্জির। যদিও উইকসের মাধ্যমে আলাপ হয় ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের সঙ্গে যে বন্ধুত্ব ছিল আজীবন। ওরেলের উদ্যোগেই প্রথম তিনি ইংল্যন্ড পাড়ি দেন। সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের রয়টন ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য। ছয় মাস খেলার সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরেই বাড়িতে বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন। মন্টু ব্যানার্জির মা চাননি যে ছেলে বিদেশে যান। ফলে বাড়ি ফিরতেই তিনি পাসপোর্ট পুড়িয়ে দেন। মন্টু ব্যানার্জিও মাকে দয়া কথা রাখতেই হোক বা অভিমানেই হোক, আর কখনও আবেদন করেননি পাসপোর্টের জন্য।
কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে? ১৯৫২-৫৩, পুটু চৌধুরী এবং মন্টু ব্যানার্জি আগুন ধরিয়ে দিলেন রঞ্জি ট্রফিতে। সারা টুর্নামেন্টে ২৬ উইকেট নিলেন।
ফাইনাল ইডেন গার্ডেন্সে, হোলকারের সঙ্গে। ব্যাট করতে নেমে বাংলা ৪১৮-এ ৯। পুটু চৌধুরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে শেষ উইকেটে মন্টু ব্যানার্জি ৬১ রান যোগ করলেন। নিজে করলেন ৩১। তারপর বল করতে নেমে বি বি নিম্বালকরের দ্বিশতরান ও মুস্তাক আলির ৯৯এর সুবাদে ১৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ লিড পেল হোলকার। যদিও মন্টু ব্যানার্জি একটাই উইকেট পেলেন, কিন্তু সেটি নিম্বালকরেরই।
দ্বিতীয় ইনিংসে, ঝড়ো ব্যাটিং করে মাত্র ৪৮ ওভারে ৫ উইকেট খুইয়ে বাংলা সিকে নাইডুর হোলকারের জন্য লক্ষ্য রাখল ৩০৪ রানের। ১০৫ ওভার বল করে ৯ উইকেট ফেলতে পারল বাংলা। এক চুলের জন্য রঞ্জি ট্রফি হাতছাড়া হল সেবার।
পরের বছরই মন্টু ব্যানার্জির শেষ বছর ছিল ঘরোয়া ক্রিকেটে। উড়িষ্যার বিরুদ্ধে খেলার পর সফরকারী কমনওয়েলথ দলের সঙ্গে ২ উইকেট নিলেন। সেটাই তাঁর শেষ ম্যাচ। তারপর কলকাতা কর্পোরেশনের অধিকারী পদে কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বাংলা দলের ম্যানেজার বা নির্বাচকের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তাঁর ছেলে রবি ব্যানার্জিও বাংলার হয়ে খেলেছেন রঞ্জি।
১৯৯২তে মারা যান, ৭২ বছর বয়সে। ফেডারেশন দু বছর পর ভেঙে ইস্ট ক্যালকাটা ডিসট্রিক্ট স্পোর্টস কাউন্সিল হয়ে গেল। আমরা অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেখানেই চলে এলাম। মাঝেমধ্যে হয়তো দেখেছি ওকে।
কিন্তু আজ যখন হঠাৎ লিখতে বসলাম, লক্ষ্য করলাম শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে আড়াই বছর আগেই। নেট ঘেঁটে দেখতে গেলে শুঁড়া স্পোর্টিং ক্লাবের একটা ইউটিউব ভিডিও পাওয়া যায়। আর অভিষেক ব্যানার্জি ও এই সময়ের একটি স্মৃতিচারণ। এইভাবেই হয়তো আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে ভুলে যাব।
মন্টু ব্যানার্জী হয়তো আরও বেশ কিছুদিন খেলতে পারতেন টেস্ট ক্রিকেট। পারেননি, কারণ খুঁজতে বসলে অনেক কিছুই হয়, আবার কোনও কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন পাওয়া যাবে না যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তার পরেও বেশ কিছু বাংলার খেলোয়াড় কেন ভারতের হয়ে খেলল না তার কারণ। তবু আমাদের প্রজন্মের একটা দায়িত্ব থেকেই যায় এই সব ভুলে যাওয়া চরিত্রগুলিকে সামনে নিয়ে আসার। স্মৃতির মাধ্যমেই তর্পণ সম্পন্ন হয়।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক