‘হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে। আর্জেন্টিনার এক প্রাক্তন ফুটবলার।’ – খুব ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে শুনতে। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে আদ্যন্ত ছাপোষা ফুটবলার। দেশের জার্সিতে সাফল্য বলতে ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে সোনা জয়। এছাড়া? নেই। কিচ্ছু নেই। ক্লাব ফুটবলেও সফলতা ধরা দেয়নি।
রিকেলমেকে বিশ্ব ফুটবলে মনে রাখার মতো কারণ রিকেলমে নিজেই তৈরি হতে দেয়নি। অথবা, বিধাতা চাননি, কেউ তাকে মনে রাখুক। তবু, এত বছর পরেও, মনে তো রাখে কেউ না কেউ।
২০০৪-০৫। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে ১-০ এ জিতে আর্সেনাল খেলতে এসেছে ভিয়ারিয়ালের হোম গ্রাউন্ডে। ভিয়ারিয়ালের তৎকালীন কোচ ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনির সবচেয়ে বড় ভরসা রিকুয়েলমে, ম্যাচের শেষ মিনিটে মারতে গেল পেনাল্টি। আর্সেনালের গোলে জার্মান গোলরক্ষক জেন্স লেহম্যান।
রেফারি বাঁশি বাজালো, পেনাল্টি মারাও হল, কিন্তু লেম্যানের হাতে জমা পড়ে গেল! স্বপ্নভঙ্গ! হতাশ মুখে দু’হাঁটু ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে রিকুয়েলমে, যার পায়ের একটা শট ভিয়ারিয়ালের জন্য খুলে দিতে পারতো ফাইনালের দরজা। বার্সেলোনার মুখোমুখি হয়ে নিজের প্রতি অপমানের জবাব দেওয়ার, একটা অন্তত সুযোগ রিকুয়েলমে পেত। তার বদলে কপালে জুটল ব্যর্থতার তকমা।
এই ব্যর্থ মঞ্চের ঠিক একবছর পরের ঘটনা। ২০০৬, জার্মানি বিশ্বকাপ। কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা-জার্মানি। মাইকেল বালাকের নেতৃত্বে থাকা তরুণ জার্মান দলের সামনে একের পর এক প্রতিভাধর আর্জেন্টিনিয়। ক্যাম্বিয়াসো, তেভেজ, মাসচেরানো, তরুণ মেসি সমৃদ্ধ দলের মধ্যে উদাসী বাউল হয়ে মাঠে ঘুরছেন কবি রিকুয়েলমে। যার অদ্ভুত পজিশনিং, অফ দ্য বলে একেবারে পারফেক্ট পজিশনে চলে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা বাকি ১০ জনকে পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট।
সেই রিকুয়েলমেকে কোচ জোসে পেকারম্যান তুলে নিলেন সেকেন্ড হাফের প্রায় শেষদিকে। হার্নান ক্রেসপোকে তুলে জুলিও ক্রুজ। সে সময় আর্জেন্টিনা ১-০তে এগিয়ে। ম্যাচ জেতারই কথা। ওই শেষ ১৫ মিনিটে ম্যাচ পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে চলে এল জার্মানদের দখলে।
শোয়েইনস্টাইগার, মাইকেল বালাক, ফিলিপ লাম কিংবা মিরোস্লাভ ক্লোজরা পুরো মাঝমাঠ জুড়ে শুরু করল অসংখ্য পাস খেলা। ফলত, আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকল নীল-সাদা ডিফেন্সে। বল উড়িয়ে খেলতে শুরু করল, আর দিশাহারা হয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনা খেয়ে গেল গোল!
সেই জার্মান টিমের গোলরক্ষকের নাম জেন্স লেহম্যান। অলিভার কান আর ম্যানুয়েল নয়্যারের মধ্যবর্তী জেনারেশনের এক আন্ডাররেটেড গোলরক্ষক। রিকুয়েলমের মনে জমে থাকা জবাব দেওয়ার সুযোগ, এবারও অধরাই থেকে গেল।
আর অধরা থেকে গেল চিরকালের বাসনা, স্বপ্ন। ক্লাবের হয়ে, দেশের হয়ে, নিজের হয়ে – রিকুয়েলমে শত শত আর্জেন্টিনা সমর্থকদের বুকে লেগে থাকা পোড়া দাগ। ছাই হয়েই থেকে গেছে, মিলিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। রিকুয়েলমে এমনই শিল্পী, এমনই ভালোবাসার প্লেয়ার।
ঠিক কেমন খেলতেন রিকুয়েলমে? এককথায় যদি উত্তর দেওয়া সম্ভব হতো, তা’হলে তাবড় ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলতেন ওর’ম মনভোলানো ড্রিবল। কিন্তু শুধু তাই? সমবয়সী এবং ফুটবলার হিসেবে অনেক যোজন এগিয়ে থাকা জিদান সব পেয়েছেন, তারও ড্রিবল দর্শনীয়ই ছিল। তবু রিকেলমে জনপ্রিয় বহু ফুটবলপ্রেমীর কাছে তার ঠান্ডা মস্তিষ্কে গোটা মাঠে অবাধ বিচরণের জন্য।
ফ্রি-কিকেও সমান পারদর্শি থাকা এই ঋষিপ্রতিম ১০ নম্বরের অসামান্য পজিশনসেন্সের দৌলতে সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টেনেগ্রোর বিরুদ্ধে সেই ঐশ্বরিক ২৪ পাশে ক্যাম্বিয়াসোর গোল। স্লো মুভমেন্ট, দর্শনীয় ড্রিবল, অসামান্য পাসিং এবিলিটি এবং অফ দ্য বল পজিশনিং – আর্জেন্টিনার ওই তরুণ ব্রিগেড পুরোপুরি পোক্ত হওয়ার আগে রিকুয়েলমে ছিলেন দলের মূল চালিকাশক্তি।
যাকে সেই ১৯৯৮-৯৯ সালে জোসে পেকারম্যান খুঁজে এনেছিলেন এবং আর্জেন্টিনাকে উপহার দিয়েছিলেন। নিজের জীবনে বারবার শনির আঘাত সহ্য করে, ‘পেকারম্যান’স চাইল্ড’ বলে ব্যঙ্গ শুনে, বহু অপমান সয়েও রিকেলমে যে ফুটবল উপহার দিয়ে গেল, তাতে ওই জেনারেশনে যে কত ফুটবলপ্রেমী আর্জেন্টিনা সমর্থক হয়েছে, তা গুনে শেষ করা যাবে না।
If you can keep your head when all about you
Are losing theirs and blaming it on you,
If you can trust yourself when all men doubt you,
But make allowance for their doubting too.
রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের লেখা শব্দবন্ধ। ‘ইফ’, যদি। কত শত নীল-সাদা ভালোবাসা পাগলরা রাত জেগে মনে মনে কত সহস্রবার এই একটা শব্দ উচ্চারণ করে গেছে, একবার যদি, একবার যদি।
রিকুয়েলমের জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। তার মধ্যেও কাঠগোলাপের ছায়ায় ঢাকা আর্জেন্টিনিয়দের জন্য, উদীয়মান সূর্য হিসেবে আগত ১৯ নম্বর মেসির জন্য ছেড়ে গেছিলেন ১০ নম্বর জার্সি। আর্জেন্টিনা ফুটবল মানেই এক বড় উপন্যাসের পাতায় পাতায় চোখের জল, ব্যর্থতার কালো মেঘের আস্তরণ, অনুযোগ-অভিযোগের শিলালিপি – ২৮ বছর পর সে উপন্যাসে একটা ট্রফি জয়ের ইতিহাস, রিকুয়েলমে এগুলোর কোনওটায় নেই, কোথাও নেই।
রিকুয়েলমে তার থেকে বহুদূরে। যেখানে হ্যামিলনের বাঁশি নিয়ে চলে গিয়েছিল একদিন। কেউ তাঁর সন্ধান জানে না। কেউ না।