ফিটনেস ছাড়া ক্রিকেটই নয় প্রায় সব খেলাতেই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে ক্রিকেট পাড়ায় বহু ক্রিকেটার এই ফিটনেসের ‘মিথ’-কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খেলে গেছেন লম্বা সময়। বিশাল শরীর, বিরাট একটা দর্শনীয় পেট নিয়েও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে ছিলেন দীর্ঘদিন। স্যার ডব্লিউ জি গ্রেস থেকে শুরু করে আকরাম খান, ডোয়াইন লেভেরক, জেসি রাইডার কিংবা হালের রাকিম কর্নওয়ালরা এর জলন্ত উদাহরণ। এই তালিকায় আরো একজন আছেন আফগান তারকা মোহাম্মদ শাহজাদ!
বিশাল বপুর কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুবার হাসির পাত্র হয়েছেন। ফিটনেস ইস্যুতে জাতীয় দল থেকে বাদও পড়েছেন কয়েকবার। প্রশ্ন উঠেছে ব্যাটিং টেকনিক নিয়েও। তবে সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে নিজের মারকাটারি ব্যাটিংয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আফগানদের প্রতিনিধিত্ব করছেন দীর্ঘসময় ধরে। আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ পেতে আফগানিস্তান ক্রিকেটে যে ক’জনের অবদান রয়েছে তাঁদের একজন শাহজাদ।
শাহজাদের বংশ আফগানিস্তানের হলেও পরবর্তীতে দেশটিতে যুদ্ধ বাঁধলে তাঁর পরিবার পাকিস্তানের পেশোয়ারে শরনার্থী শিবিরে চলে যায়। সেখানে ১৯৮৮ সালের ৩১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন শাহজাদ। এমনকি তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে পাকিস্তানেই।
২০০৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে আফগানিস্তানের হয়ে সুযোগ পান তিনি। সেখানে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন শাহজাদ। আর সেই টুর্নামেন্টের পরই ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ করে আফগানিস্তান। ওই বছরই জিম্বাবুয়ে একাদশের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক।
২০১০ সালে কানাডার বিপক্ষে প্রথম আফগান ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি গড়েন শাহজাদ। সেবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ফাইনালে তাঁর অসাধারণ এক ফিফটিতে শিরোপা জেতে আফগানিস্তান। ৮০ গড়ে ২ সেঞ্চুরি ও ৫ হাফ সেঞ্চুরিতে ৮০২ রান করেন এই ওপেনার।
২০০৯ সালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকের পর দ্বিতীয় ম্যাচেই প্রথম আফগান ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরির হাঁকান শাহজাদ। পরের বছর ব্যাট হাতে উড়ন্ত ফর্মে ছিলেন এই আগ্রাসী ওপেনার। ওই বছর ১২ ওয়ানডেতে ২ সেঞ্চুরি ও ৩ ফিফটিতে ৪৭ গড়ে ৫১৭ রান করেন শাহজাদ। একই বছর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত হন এই তারকা।
এরপর বেশ কয়েক বছর রঙিন পোশাকে ছিলেন চরম ব্যর্থ। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুযোগ পেলেও ছিলেন সাদামাটা। বেশ কয়েক বছর দলের অনিয়মিত মুখ হিসেবে খেলার পর ২০১৫ সালে তিনি আবারো স্বরূপে ফেরেন। সেবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ফিফটি ও এক সেঞ্চুরিতে ৫২ গড়ে ৩১২ রান করেন শাহজাদ।
টি-টোয়েন্টিতেও দেখা পান তিন ফিফটির। পরের বছর ২০১৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৭ বলে ১১৮ রানের পথে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের মেইডেন সেঞ্চুরির দেখা পান শাহজাদ। সেবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জায়গা করে নেন ‘টিম অব দ্য টুর্নামেন্টে’।
ততদিনে দুই ফরম্যাটেই দলের অন্যতম ভরসা হয়ে ওঠেন এই ওপেনার। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর আগ্রাসী ব্যাটিং ছিল প্রতিপক্ষের জন্য বড় হুমকি। ২০১৬ সালে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কারও জেতেন তিনি।
এরপর ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ ড্রাগ নেওয়ার প্রমাণ মেলায় এক বছরের নিষেধাজ্ঞা পান এই ওপেনার। আইসিসি ডোপিং আইন ভঙ্গের দায়ে নিষেধাজ্ঞা পেলেও তিনি জানান এই ড্রাগ নিষিদ্ধ তিনি তা জানতেন না। অবশ্য সতীর্থ ক্রিকেটাররাও শাহজাদকে সমর্থন করেন। এক বছর সাজা কাটানোর পর ২০১৮ সালে আবারো ক্রিকেটে ফেরেন তিনি।
২০১৮ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করেন এই ওপেনার। ১১৬ বলে ১২৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসে ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচ টাই করে আফগানরা। একই বছর ভারতের বিপক্ষে নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের উদ্বোধনী ম্যাচে একাদশে জায়গা করে নেন তিনি।
এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা পান তিনি। কিন্তু পরক্ষনেই ফিটনেস ইস্যুর দোহাই দিয়ে হুট করেই দল থেকে বাদ দেওয়া হয় শাহজাদকে। বলা হয়েছিল ইনজুরির সমস্যা আছে তাঁর। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে সেটি ভুল বলে সম্বোধন করেন শাহজাদ। এমনকি তিনি জানান তিনি সম্পূর্ণ ফিট ও সুস্থ থাকা সত্ত্বেও বোর্ড থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। অবশ্য পরবর্তীতে বছর খানেকের মধ্যেই আবারো দলে জায়গা পান এই ওপেনার।
মোহাম্মদ শাহজাদ একমাত্র পুরুষ ক্রিকেটার যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একই দিনে দুইটি ভিন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। ২০১৭ সালে টি-টোয়েন্টি কাপে দুবাইতে ওমানের বিপক্ষে ৮০ রানের পর একই দিনে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৫২ রানের হার না মানা এক ইনিংস খেলেন এই ওপেনার।
শাহজাদের ব্যাপারে একটি মজার তথ্য হল – এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ছোট থেকেই গরুর মাংস আমার খুব প্রিয়। আর অতিরিক্ত মেদও এই গরুর মাংস খাওয়ার কারণে। তবে মেদ কমানোর জন্য গরুর মাংস খাওয়া ছাড়তে পারবো না।’
শাহজাদকে আফগানিস্তানের সিংহভাগ ক্রিকেট ভক্তই ‘আফগানিস্তানের ধোনি’ হিসেবে জানে। এর কারণ ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ছিল তাঁর আইডল। এমনকি ধোনির মত অবিকল হেলিকপ্টার শটও মারতে পারেন শাহজাদ। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে পেসার জহির খানের বলে হেলিকপ্টার শট খেলেন শাহজাদ। আর তখন উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর আইডল ধোনি।
এক দশকের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তান ক্রিকেটকে শূন্য থেকে এ পর্যন্ত আনতে নিজের সেরাটা দিয়েছেন মোহাম্মদ শাহজাদ। তাঁর ভুঁড়ি কিংবা ফিটনেসের কারণে উপহাস, ঠাট্টা করলেও যে কেউ মানতে বাধ্য আফগান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অস্ত্র তিনি।