রাজপথ থেকে মাঝমাঠ: কান্তের ২০ বছর

ফ্রান্সের সেন্ট ডেনিস স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ চলছে। শিরোপার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মেতেছে ব্রাজিল ও ফ্রান্স। সময়টা তখন ১৯৯৮। ফরাসিদের ফুটবল জাদুতে বুঁদ হয়ে আছে ফুটবল বিশ্ব। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে উদ্বেল স্টেডিয়াম।

গ্যালারিতে ফ্রান্স ভক্তদের উল্লাস থামছেই না। বিশ্বব্যাপী আগত হাজার হাজার দর্শকের ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের বোতল, বিয়ার ক্যান ছড়িয়ে রয়েছে যত্রতত্র। ৮ বছর বয়সী একটি ছেলে আপনমনে সেইসব বোতল কুড়িয়ে নিজের থলেতে ভরছে। নাম তাঁর এনগোলো কান্তে।

মাঠের লড়াইয়ের দিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। যত বেশি বোতল, ক্যান কুড়িয়ে বিক্রি করতে পারা যায়, তাতেই লাভ তাঁর। এইসব খেলার মৌসুমে ভালো কামাই করা যায়। বাবা মারা গেছে ছোটবেলায়। দিনশেষে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র বিক্রি করে যা টাকা পায়, নিয়ে মায়ের হাতে দেয় সে। কান্তের মা কাজ করে শহরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। সব মিলিয়ে কোন রকমে মা ও চার ভাইবোনসহ কান্তের সংসার চলত।

সেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয় ফ্রান্স। সেই সাথে ফ্রান্সের শক্তিশালী ফুটবল যুগের সূচনা ঘটলো। আর এতক্ষণ যে ‘টোকাই’ ছেলেটির কথা বললাম, সেই ছেলেটি আজ কোথায় জানেন? যেই ছেলে সেই ১৯৯৮-র ফুটবল বিশ্বকাপের উল্লাসে গা না ভাসিয়ে জীবিকার চিন্তা করছিল, সেই ছোট্ট ছেলেটি বড় হয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার বনে গিয়েছে। এনগোলো কান্তে ফ্রান্স জাতীয় দলের হয়ে খেলেন।

২০১৮ সালে ফ্রান্স দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে। আর মজার ব্যাপার হলো এই বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন এনগোলো কান্তে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে লিওনেল মেসিকে একাই কাবু করে রেখেছিলেন কান্তে।

সেই ম্যাচ জিতেই বিশ্বকাপ জয়ের ছন্দ খুঁজে পায় ফ্রান্স। ফ্রান্স এবং ক্রোয়েশিয়ার মধ্যকার ফাইনাল ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ফ্রান্স ৪-২ ব্যবধানে তাঁদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা লাভ করে।

আর ক্লাব ফুটবলে চেলসির বড় তারকা সে। তার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে মাত্র নয় বছর আগে। এই নয় বছরে এনগোলো কান্তে একে একে জিতেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, বিশ্বকাপ ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। বরাবরই দলের অপরিহার্য সদস্য এই ফ্রেঞ্চম্যান।

কান্তেকে নিয়ে ইন্টারনেটে একটি জোক প্রচলিত আছে যে, ‘পৃথিবীর ৭০ ভাগ পানি আর বাকি ৩০ ভাগ কান্তে’। প্রতিটি ম্যাচে মাঠের সবটাজুড়ে দৌড়ানো কান্তের ওয়ার্ক রেটের জন্যই এমন কৌতুক প্রচলিত। মাঠের দুর্দান্ত এই মিডফিল্ডার বাস্তবিক জীবনে দারুণ বিনয়ী, অমায়িক একজন মানুষ। বেশ ধর্মপ্রাণ এই এই ফুটবলারকে সতীর্থরাও দারুণ ভালবাসেন। আর ভালবাসবেন নাই বা কেন, এই সময়ে তাঁর মানের পরিশ্রমী মিডফিল্ডার আর নেই বললেই চলে।

আপনি যদি বিফোর-আফটার ট্রেন্ডের কথা বলেন, তবে কান্তের চেয়ে ভালো বিফোর-আফটার হতে পারে না। যেই ছেলে ১৯৯৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে স্টেডিয়ামের ময়লা- আবর্জনা কুড়ানোতে ব্যস্ত ছিল, সেই ছেলেটিই ঠিক বিশ বছর পরে একই দলের হয়ে বুক চিতিয়ে মাঠে লড়তে নেমেছেন। একেবারে দলকে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতিয়ে কোটি ভক্তের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাঠ ছেড়েছেন। দিস ইজ কল্ড, ‘দ্য আল্টিমেট টোয়েন্টি ইয়ার্স চ্যালেঞ্জ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link