রাহুল, কান্নাউর লোকেশ রাহুল। নামটা লোকে ভুল করে অনেক সময় রাহুল দ্রাবিড় বলে ফেলে। জায়গাটাও তো এক — ম্যাঙ্গালোর থেকে ব্যাঙ্গালুরু। দু’জনই মিডল ক্লাস, শিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে আসা। কিন্তু একজন নিজেকে ‘দ্য ওয়াল’ বানিয়েছেন, অন্যজন? কেএল রাহুল এখনো খুঁজছেন নিজের ঠিকানা। তবে, যেভাবে হাঁটছেন পথের শেষে অবধারিত জয়ই লেখা আছে।
বাবা-মা দু’জনেই অধ্যাপক। সেই ঘরের ছেলে যখন ক্রিকেটে পা রাখেন, তখন প্রশ্ন ছিল একটাই—এই ছেলে কি টিকতে পারবে? ম্যাঙ্গালোরে জন্ম, বেঙ্গালুরুতে বেড়ে ওঠা। ২০০৯ সাল, যখন পড়াশোনার বই রেখে ক্রিকেট ব্যাটটা একটু বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে তার জীবনে।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে নাম ছিল, আলো ছড়াতে পারেননি। ক্যারিয়ারের শুরুতেই হোঁচট। তবে থেমে থাকেননি। দিনের পর দিন নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার এক নি:শব্দ লড়াই চালিয়ে গেছেন। ২০১৩-১৪ রঞ্জি ট্রফি ছিল সেই লড়াইয়ের পুরস্কার। ১০৩৩ রান করে আসর সেরাদের তালিকায় নিজের নাম তোলেন রাহুল।
তারপর দুলীপ ট্রফির ফাইনাল। দুই ইনিংসে দুই শতক করে দরজাটা ঠেলে দেন জাতীয় দলে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই প্রথম সুযোগ। ব্যাগি গ্রিনের দেশে টেস্ট অভিষেক।
রাহুলের গল্পটা একরকম ‘নো ড্রামা, অল ডিসিপ্লিন’। মাঠে তিনি শোরগোল তোলেন না, ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন। কেউ যখন চার নম্বরে ব্যর্থ, তাকে তিনে খেলায়; যখন ওপেনার চোটে ছিটকে যান, তাকে ওপেন করতে পাঠানো হয়। যখন ফিনিশারের দরকার পড়ে, তখন তিনি পাঁচে। আর সবার শেষে, উইকেটকিপিংয়ের গ্লাভস হাতে তুলে নিতেও দ্বিধা করেন না।
ক্রিকেটের বাজারে ‘ইউটিলিটি’ কথাটা আজও বহু খেলোয়াড়ের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং চাপের। কিন্তু রাহুল যেন সেই চাপটাকে নিজের মতো করে কাজে লাগিয়েছেন। ওয়ানডেতে ওপেন করলে গড় ৫০-এর বেশি, পাঁচে নামলে গড় ৫৭-এর বেশি—এই ধারাবাহিকতা শুধু পরিসংখ্যান নয়, আত্মস্থ এক নম্রতা। তারপরও, কোনো ফরম্যাটে চাইলে তাঁকে ছিটকে ফেলানো যায়, টিম কম্বিনেশনের দোহাইয়ে তাঁকে যেখানে সেখানে ব্যাট করতে পাঠানো যায়।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে দলের মালিক তাঁর সাথে চাইলেই দূর্ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু, লোকেশ রাহুল জবাব দিতে জানেন, চোখ রাঙিয়ে বলতে পারেন – এই মাঠই আমার রক্ত সিংহাসন। সেখানে হয়তো আমার ওপর আঘাত আসতে পারে, কিন্তু ফিনিক্স পাখি হয়ে আমি ফিরবোই।
তাঁর ব্যাটিংয়ে স্কুপ নেই, র্যাম্প নেই, শর্ট-আর্ম জ্যাব নেই। কিন্তু, আছে কভার ড্রাইভের টান, ব্যাকফুট পাঞ্চের ছন্দ। চোখের আরামে খেলা যে ব্যাটাররা আজকাল কমে গেছে, রাহুল সেখানেই আলাদা। তিনি আসলে সব কিছু পারেন, যখন যেখানে যেমন চাই ঠিক তেমনই তিনি। তিনি ভারতের দু:সময়ের ঢাল। তিনি ভারতের দুর্যোগের লড়াকু সেনানি।
হয়তো তিনি কখনো রাহুল দ্রাবিড় হবেন না। তবে একজন ‘কে এল রাহুল’ও সবাই চাইলেই হতে পারে না। তিনি যখন যেখানে থাকেন, সেখানে ভরসা থাকে। রাহুল দ্রাবিড় হয়তো দেওয়াল তুলে দিতেন, আর লোকেশ রাহুল প্রতিপক্ষের গড়া দেওয়াল ভেঙে জয় নিশ্চিত করতে জানেন। বাবা-মার আক্ষেপ আছে, কেন ছেলেটা আরও পড়ুয়া হল না – কিন্তু ভারতের তাঁকে নিয়ে কোনো আক্ষেপ থাকার কথা নয়।