নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না।’ লাইনটা কেনো জানি না, সেমিফাইনালে পাকিস্তানের হারের পর সমাজ মাধ্যম দেখতে দেখতে আরো বেশি করে মনে হচ্ছে। আরেকটু নবারুণ ধার করেই বলি, ‘ইস্তাহারে দেয়ালে স্টেনসিলে কবিতা এখনই লেখার সময়।’ এটা কবিতা নয়। নিছক গদ্যাকারে লেখা কিছু হাবিজাবি মাত্র।
কিন্তু আন্দাজ করছি, এই লেখা লোকচক্ষুর সামনে আসার পর, ডিজিটালি মারধোর খেয়ে যাবো। লেখাটা অবশ্য ‘নিজের রক্ত, অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে লেখা নয়।’ আরাম করে চাদর গায়ে বসে কিবোর্ডে টাইপ করা। কিন্তু লেখাটা একটা গরজ থেকে লেখা। সেই গরজ যা সারাদিন কাজের পরেও আমাকে দিয়ে দু-এক লাইন ক্রিকেট লিখিয়ে নেয়। সেই গরজ যা আমাকে ভোর বেলা উঠিয়ে অষ্ট্রেলিয়ার টেস্ট ম্যাচ ও রাত্তির বেলা জাগিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ম্যাচ দেখায়। সেই গরজ যা এই ধেড়ে বয়সে এসেও ছুটিতে বাড়ি ফিরে পাড়ায় একটু ক্রিকেট খেলিয়ে নেয়।
তা যাক, এসব গৌরচন্দ্রিকা না করে আসল বিষয়ে আসা যাক। কাল পাকিস্তানের হারের পর থেকে যা উল্লাস দেখছি, তাতে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে মায়ের মুখে যে ওয়াসিম আকরাম আর ইমরান খানের পোস্টার জমানোর গল্প শুনেছিলাম, সেটা এই পৃথিবীর গল্প না, একটা সমান্তরাল পৃথিবীর ঘটনা। আর মাদ্রাজ টেস্টের পর গোটা মাঠের দাঁড়িয়ে হাততালি? সেটা বোধহয় মঙ্গলগ্রহেই ঘটে থাকবে। তবে এটা অবশ্য ভাবার কোনো কারণ নেই যে, সময়টা আলাদা বলে সবকিছুই আলাদা। খেলোয়াড়দের মুণ্ডপাত আগেও হয়েছে। ১৯৯৬ আর ১৯৯৯ এর ইডেন? ভুলে গেছি? না যাইনি।
তখনও বাজে খেললে খেলোয়াড়দের গালাগালি দেওয়া হতো। অক্রিকেটীয় ব্যাপার স্যাপার টেনে এনে, সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের বাপান্ত করা হতো। ‘শালা, এতো অ্যাড করলে খেলবে কখন?’ ‘আজহারউদ্দীন নিশ্চয়ই টাকা খেয়েছে।’ ওয়াঘার ওপারে ওয়াসিম আকরাম কে শুনতে হয়েছে, ‘ভারত ম্যাচ না খেলে যে টাকাটা পেলে, সেটা কোথায় লুকিয়েছো?’
কিন্তু তখনের সাথে এখনের মৌলিক ফারাক একটাই, এই আবেগের স্ফুলিঙ্গ শুধুমাত্র ভারত খেললেই গর্জে উঠতো। খুব বেশি দূর যেতে হবে না। এমনকি সমাজ মাধ্যম বহির্ভূত সময়তেও না। ২০১২ সালের কথা। ভারত পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একই গ্রূপে। ভারত প্রথম পর্বেই বিদায় নিয়েছে। পাকিস্তান সেমিফাইনালে গিয়ে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরেছে। সুরেশ রায়নার টুইটার একাউন্ট থেকে টুইট করা হলো, ‘কিরে! সেই তো একটা ম্যাচ পরেই বেরিয়ে গেলি। তাও এতো নাচানাচির কি ছিল?’
এরপর যে তীব্র সমালোচনা তিনি প্রতক্ষ্য করেন, তা বলার নয়। শেষমেশ তাঁকে স্বীকার করতে হয়, তাঁর একাউন্টে ‘কেহ বা কাহারা চুরি করিয়া এসব লিখেছে।’ অন্তত ওয়াঘার এপারে ব্যাপারটা এই পর্যায়ে পৌঁছায় নি। ওপারের কথা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারবো না।শোনা যায় অর্জুন রণতুঙ্গা কে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সময় লাহোরের ফ্লাইটে সেমিফাইনালে ভারতকে হারানোর জন্যে পাকিস্তানের জাতীয় বিমান সংস্থা অভিনন্দন জানায়। অবশ্য লাহোরে সৌরভের ভারত সিরিজ জেতার পর পাকিস্তানি ‘আওয়াম’ যে পরিমান ‘মেহমাননাওয়াজি’ দেখিয়েছিলো, তা গৌতম ভট্টাচার্য্য বিস্তারে লিখে ফেলেছেন।
যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। পাকিস্তান গতকাল হেরেছে , এবং তাই তাঁদের ব্যঙ্গ করে যে পরিমান মিম দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ার প্রশংসা করে তার সিকি ভাগও দেখিনি। আজকের ব্যাক্তিপুজোর ক্রিকেট ভক্তিতে যে আসল ক্রিকেট ভক্তির প্রতি কতটা হানিকারক, সেটা সমাজ মাধ্যম দেখলেই বোঝা যায়। সে বিষয়ে বিস্তারে যাচ্ছিও না।
ভয় শুধু একটাই। ক্রিকেট বিদ্বেষের ইউরেনিয়াম চেন রিয়েকশন করতে করতে না একদিন পারমাণবিক বোমার আকার নেয়। তাহলে কিন্তু আর ম্যাচ হারার পরেও বিরাট কোহলি মোহম্মদ রিজওয়ানকে আলিঙ্গন করবেন না। আর দুদিন আইসিইউতে থাকার পরে রিজওয়ানের ব্যাট করতে নামা নিয়েও ভারতের কেউ আর ফেবু পোস্টও দেবেন না। কোন পৃথিবীটা চান একবার ভেবে দেখে নিন।