নেইমার ফিরলেন, ফিরলেন রাজার বেশেই। সার্বিয়ার বিপক্ষে চোট পাবার পর গোটা বিশ্ববাসী প্রার্থনায় বসেছিল তাঁর ফেরার জন্য। দ্বিতীয় রাউন্ডে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে তিনি ফিরলেন, ব্রাজিলও ফিরল সুন্দর ফুটবলের পসরা সাজিয়ে।
ভয়ংকর সুন্দর ফুটবলে ৪-১ গোলে ম্যাচ জিতে শেষ আটের টিকিট কাটল ব্রাজিল। কিন্তু এতেও যেন মনে ভরেনি নেটিজেনদের, আট বছর আগের ভয়াল সেই স্মৃতি যেন তাঁদের উসকে দিতেই হবে।
কাতারের ট্রেডমার্ক ‘৯৭৪’ স্টেডিয়ামে মাঠে নামার আগে কিংবদন্তি পেলের অসুস্থতার খবর পেয়েছিলেন নেইমাররা। ম্যাচের আগে হাসপাতালে থেকেই দলকে শুভকামনা জানিয়েছিলেন কালো মানিক। সেই অনুপ্রেরণাতেই কিনা পুরনো সেই বিধ্বংসী ব্রাজিলের স্মৃতি ফিরিয়ে আনলেন তিতের শিষ্যরা।
তিতে একাদশ সাজিয়েছিলেন আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলবেন ভেবেই। দুই উইংগার রাফিনহা এবং ভিনিসিয়াসের পাশাপাশি নাম্বার নাইন নেইমার। তাঁদের সামনে স্ট্রাইকার হিসেবে ছিলেন এবারের বিশ্বকাপের চমক রিচার্লিসন।
তাছাড়া অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে লুকাস পাকুয়েতা তো ছিলেন। সবমিলিয়ে ব্রাজিলের লক্ষ্যটা ছিল পরিষ্কার, আক্রমণই সেরা রক্ষণ – এই মূলনীতি মাথায় রেখেই মাঠে নেমেছিলেন তাঁরা।
কোরিয়ানরা মাঠে পাত্তাই পাননি ব্রাজিলের কাছে। ব্রাজিলের প্রতিটি গোলই ছিল ছবির মতো সুন্দর, যেন ভ্যান গগের আঁকা কোনো শিল্পকর্ম। আধঘন্টার মাঝেই ব্রাজিল কোরিয়ার জালে বল জড়িয়েছে গুণে গুণে তিনবার।
রিচার্লিসনের গোলটা তো দলীয় ফুটবলের এক অপূর্ব প্রদর্শনী। স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭০ বিশ্বকাপে কার্লোস আলবার্তোর সেই গোলকে। প্রতিটা গোলের পর ব্রাজিলের উল্লাসও ছিল বাঁধভাঙা, নেচে-গেয়ে দর্শকদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন নেইমার-পাকুয়েতারা। এমনকি নাচে যোগ দিয়েছিলেন সদা গম্ভীর প্রফেসর তিতেও।
২০১৪ সালে ব্রাজিল বনাম জার্মানির সেই ভয়াল ম্যাচের পর এই প্রথম ম্যাচের প্রথম আধঘন্টায় তিন গোলের লিড নিয়েছে কোনো দল। সেবার গোল হজমকারী দলটা ছিল ব্রাজিল, এবার গোলদাতা ব্রাজিল। ব্রাজিলের এই উৎসবের মুহূর্তেই তাই সেদিনের কথা স্মরণ করিয়ে খোঁচা দিতে ছাড়েননি অনেকে।
ফুটবলে খারাপ দিন আসতেই পারে, বিশ্বসেরা দলটাও কখনো গুঁড়িয়ে যায় মুহূর্তের মাঝেই। মিনেইরোতে ব্রাজিলও সেদিন এভাবেই অসহায় আত্নসমর্পন করেছিল জার্মান মেশিনের সামনে। জার্মান ফুটবলাররা সেদিন মাঠে যা করতে চেয়েছেন, সেটাই করতে পেরেছেন।
অবশ্য ভাগ্যবিধাতাও সহায় হয়েছিল জার্মানদের সেটা কিন্তু কেউ স্বীকার করবে না। কেউ বলবে না নেইমার, থিয়াগো সিলভাবিহীন ব্রাজিল সেদিন ছিল চাপে চিড়েচ্যাপ্টা খর্বশক্তির দল। কেউ বলবে না নেইমারের সেই ভয়াবহ চোটের পর ব্রাজিল ছিল মানসিকভাবে বিধবস্ত এক দল।
ব্রাজিলের সুন্দর ফুটবলের পরও তাই ঘুরেফিরে আলোচনায় মিনেইরোর সেই সন্ধ্যা। সেই রাতের কথা, যে রাতে কেঁদেছিল গোটা ব্রাজিল, কেঁদেছিল গোটা ফুটবল বিশ্ব। মারাকানাজোর পর তো এত বড় ট্র্যাজেডি আর দেখেনি ব্রাজিল।
তবে এবারের ব্রাজিল দলটা অন্য ধাতুতে গড়া। লাতিন আমেরিকার ক্লাব ফুটবলে সমস্ত ট্রফি জেতা তিতে নিজের হাতে গড়েছেন দলটাকে। এই দলটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে না, সমালোচনা ছাপিয়ে নিজেদের কাজটা করে যায় প্রতিনিয়ত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রল ছাপিয়ে প্রতিনিয়ত মাঠে সাজিয়ে বসে সুন্দর ফুটবলের পসরা। জোগো বোনিতোর হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যে আরো মোহিত করে বিশ্ববাসীকে। হাসপাতালের বিছানায় থাকা পেলের ঠোঁটের কোনায় ফুটিয়ে তোলে মুচকি হাসি।
তাতে অবশ্য নেটিজেনদের থোড়াই কেয়ার, তাঁরা তো ব্রাজিলকে ট্রল করেই যাবেন! তবে, সেই ট্রল এবার দমাতে পারছে না ব্রাজিলকে।