সীমাহীন আক্রমণাত্মক মানসিকতা, কব্জির জোর, আর অনবদ্য স্বভাবজাত টাইমিং – তিলকারত্নে দিলশান ছিলেন এই তিনের সংমিশ্রন। ক্রিকেটে বিবর্তনবাদের অনন্য নায়ক হিসেবেও তাঁর নাম সবার ওপরেরর দিকেই আসবে।
দিলশান হলেন ভিভ রিচার্ডস বা বীরেন্দ্র শেবাগ ঘরানার ব্যাটসম্যান। তাঁর জন্য রক্ষণ হল রণকৌশলের সর্বশেষ অস্ত্র। যদিও, টেকনিক্যালি যথেষ্ট সাউন্ড ছিলেন। জায়গা করে অফ সাইডে কাট করতে, কিংবা ড্রাইভ করতে ভালবাসতেন।
২০০৯ সালের আগ পর্যন্তও তিনি সাদামাটা মানের এক অলরাউন্ডার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে, এই বছরটায় এসে ক্যারিয়ার আমূল পাল্টে যায় তাঁর।
শ্রীলঙ্কান টিম ম্যানেজমেন্টের অভিনব এক সিদ্ধান্তে তাঁর ব্যাটিং পজিশনে পরিবর্তনটা এগিয়ে ওপেনিংয়ে নিয়ে আসে। সেটাও আবার তিন ফরম্যাটেই। আর সেটাই ছিল দিলশানের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট।
ওই বছর ১১ টা সেঞ্চুরি করেছিলেন দিলশান না। ভুল পড়েননি, ১১ টা সেঞ্চুরি! বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি।
এক পঞ্জিকা বর্ষে এক হাজার রান দিলশান পেয়েছেন চার বার। ২০০৯ থেকে ২০১৫ – এই সমেয় প্রতিটি বছরই কমপক্ষে ৮০০ করে রান করেছেন দিলশান। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে তিনি মাত্র চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ১০ হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছান।
অধিনায়কত্বও পেয়েছিলেন একটা সময়, সেই যাত্রা সুখকর ছিল না। তবে, অধিনায়ক হিসেবে একটা দারুন রেকর্ড আছে তাঁর। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ক্রিকেটার যিনি অধিনায়ক হিসেবে তিন ফরম্যাটেই সেঞ্চুরি করেছেন।
আধুনিক ক্রিকেটে ‘স্কুপ’ শটের প্রসারে দিলশানের নাম আসবে শুরুর দিকে। তবে, তাঁর স্কুপটা একটু ব্যাতিক্রমী ছিল। তিনি বোলিং ডেলিভারির গতি ব্যবহার করে উইকেটরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে এই শট খেলতেন। এটা এতই জোড়ালো হত যে, থার্ডম্যান থেকে এসে ফিল্ডারের পক্ষে বাউন্ডারি আটকানো সম্ভব হত না।
জাতীয় দল বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে – যে কোনো টি-টোয়েন্টি দলে তাঁর উপস্থিতি ছিল আশীর্বাদের মত। ব্যাটিং ঝড়ের কথা তো কারোই অজানা নয়, এর বাদে তিনি কার্যকর অফস্পিনার, জুটি ভাঙতে তাঁর জুড়ি ছিল না। আবার চাইলে উইকেটরক্ষণের কাজটাও মন্দ ছিল না। সাথে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্ষিপ্র গতির ফিল্ডিং ছিল বাড়তি পাওয়া। তিনি সত্যিকারের ইউটিলিটি অলরাউন্ডার।
২০০৯ সালে সেই বদলে যাওয়ার বছরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। সেই বিশ্বকাপেই দিলস্কুপ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন দিলশান। ওই বছর পুরস্কৃত হয়েছিলেন আইসিসির মঞ্চেও।
সেই ২০১৬ সালে খেলা ছাড়লেও আজও ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে লঙ্কানদের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। শর্টার ফরম্যাট তাঁর শক্তির জায়গা হলেও লঙ্গার ভার্সন যে মন্দ খেলতেন তা কিন্তু নয়। টেস্টে ৪০-এর ওপর গড় দিয়ে পাঁচ হাজারের ওপর রান করেছেন।
দিলশানের ক্যারিয়ারের আক্ষেপ হিসেবে ধরা হয় তাঁর শুরুটাকে। অভিষেক সেই ১৯৯৯ সালে। অথচ, ২০০৯ সালের আগ অবধি তার প্রতিভাটা অজ্ঞাতই ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল অবধি তো দলের বাইরেই ছিলেন। পাঁচ, ছয়, সাত এমনকি আট নম্বরেও ব্যাটিং করেছেন কখনো। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আবির্ভাব না হলে, হয়তো ডানা মেলতেও পারতো না দিলশানের ব্যাট।
মজার একটা ব্যাতিক্রমী তথ্য দিয়ে ইতি টানি। ছক্কা হাঁকানোয় জুড়ি নেই দিলশানের। এর ব্যাতিক্রমও আছে আবার। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৪৬ বলে ১৬১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন দিলশান। ইনিংসে ২২ টি চার থাকলেও কোনো ছক্কা ছিল। ছক্কাবিহীন ইনিংসে এত বেশি রান এর আগে বা পরে – কেউই করতে পারেননি!
বিদায় বলে ফেলার পর আজও প্রায়ই তাঁর ঝলক দেখা যায় – কখনো লিজেন্ডস ক্রিকেটে, কখনো বা অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে। আর সেখানে তাঁর পারফরম্যান্স বারবার একটা কথাই যেন জানান দেয় – এখনো ফুরিয়ে যাননি দিলশান। আজও তিনি হারানো দিন গুলোর মতোই সিরিয়াস।