সর্বকালের সেরা লঙ্কান

‘দ্য লায়ন্স’ ডাকনামে বিশ্ব ক্রিকেটে সমাদৃত দলটি শক্তিমত্তায় বেশ শক্তিশালী দল ছিল এক সময়। তবে এই দলের স্বর্ণালি সময় বলতে গেলে বলতে হয় নব্বই এর দশক থেকে ২০১১ এর সময়কাল। কালক্রমে সেই পারফরম্যান্স অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।

শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দলটি ১৯৭৫ সালে প্রথম ওয়ানডে এবং ১৯৮২ সালে প্রথম টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু করেছিল।  এরপর থেকে ধীরে ধীরে ক্রিকেটের দুনিয়ায় নিজেদের জাত চিনিয়েছে।শ্রীলঙ্কা আইসিসি টুর্নামেন্টে বেশ সাফল্য পেয়েছে। তাদের ঝুলিতে আছে একটি ওডিআই বিশ্বকাপ (১৯৯৬) একটি টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ (২০১৪)। যৌথভাবে ভারতের সাথে ২০০২ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও জিতেছে সিংহরা। তাছাড়া শ্রীলঙ্কা ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপের রানার্স আপ দলও।

৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলায় শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু বিশ্বমানের প্রতিভা তৈরি করেছে। মুরালিধরনের মতো রেকর্ডব্রেকিং খেলোয়াড়, রানাতুঙ্গার মতো একজন দারুণ অধিনায়ক, জয়াসুরিয়ার মতো বিস্ফোরক এবং সাঙ্গাকারার মতো প্রতিভা তৈরি করেছে।

অবশ্য যখন তাদের কিংবদন্তি ও সেরা খেলোয়াড়রা অবসর নিয়েছিলেন, এরপর থেকে দলটি কিছুটা খারাপ সময় কাটিয়েছে। যাইহোক শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের সর্বকালের সেরা দশের একটি তালিকা তৈরী করা যাক, যারা ক্রিকেটের দুনিয়াকে সমৃদ্ধ করেছেন।

  • সনাথ জয়াসুরিয়া

প্রাক্তন ক্রিকেটার সনাথ জয়াসুরিয়াকে নি:সন্দেহে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বলা যায়। তিনি একজন অসাধারণ অলরাউন্ডার ছিলেন যার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার দুই দশকের বেশি ধরে বিস্তৃত। ১৯৮৯ তে তাঁর অভিষেক ঘটে। তিনি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সর্বশ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত।

জয়াসুরিয়া হচ্ছেন আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেটে একমাত্র খেলোয়াড় যার ১৩০০০ উপর রান ও তিনশতাধিক উইকেট আছে। কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নের চেয়েও বেশি সংখ্যক উইকেটতিনি নিয়েছেন ওয়ানডেতে। তিনি ১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ছিলেন। টেস্টে লঙ্কার হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। জয়াসুরিয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবমিলিয়ে বিশ হাজারে বেশি রান করেছেন।

জয়সুরিয়া তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং দ্বারা প্রথম ১৫ ওভারের  খেলার ধরণ বদলে দিয়েছিলেন এবং অনেক বিশ্বমানের বোলারদের ত্রাস ছিলেন। প্রতিপক্ষের ভক্তরাও তাঁর ব্যাটিং দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো।

  • মুত্তিয়া মুরালিধরন

তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম স্পিনার এবং সফলতম শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত। টেস্ট ক্রিকেটে একমাত্র বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেট শিকার করেছেন।

টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে তিনি ১৩৩৪ টি উইকেট নিয়েছেন। টেস্টের পাশাপাশি ওয়ানডেতে ব্যক্তিগতভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি। বাঘা বাঘা ব্যাটারদের জন্যেও তিনি ছিলেন এক অশনি সংকেত।

  • কুমার সাঙ্গাকারা 

শ্রীলঙ্কার তৈরি অন্যতম সেরা একটি প্রতিভার নাম কুমার সাঙ্গাকারা। শচীন টেন্ডুলকারের পরে ওডিআইতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। অথচ শচীনের চেয়ে ৯ বছর কম খেলেছেন।

সাঙ্গাকারা তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ২৮০০০ রান করেছেন। শ্রীলঙ্কার হয়ে টেস্ট ও ওডিআই উভয় ফরম্যাটে তিনি সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। শ্রীলঙ্কাকে ২০১১ এবং ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ২০১৫ বিশ্বকাপে সাঙ্গাকারার টানা চারটি সেঞ্চুরির রেকর্ডটি আজো ক্রিকেটবিশ্বের অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা। 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্য কোনো ব্যাটার এই কীর্তি গড়তে পারেননি। ২০১৫ সাল পর্যন্ত রান সংগ্রহের দিক দিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিকে দ্বিতীয় ও টেস্ট ক্রিকেটের ৫ম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। এছাড়াও উইকেটরক্ষক হিসেবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ডিসমিসাল তার দখলে।

  • মাহেলা জয়াবর্ধনে 

১৯৯৭ সালে অভিষেক ঘটেছিল এই ক্রিকেটারের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম রয়েছে। তৃতীয় শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে জয়সুরিয়া ও সাঙ্গাকারার পর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি দশ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন।

তাছাড়া ফিল্ডিংয়ে ছিলো অসাধারণ দক্ষতা। ওডিআইতে সর্বোচ্চ রান আউট তাঁর দখলে। তাঁর অধিনায়কত্ব শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। জয়াবর্ধনের নেতৃত্ব শ্রীলঙ্কাকে ২০০৭ সালে ফাইনালে নিয়ে যান। ২০১১ এবং ২০১৪ বিশ্বকাপে দারুণ অবদান রেখেছিলেন। জয়াবর্ধনে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় যিনি টেস্টে দশ হাজার রানের রেকর্ড ছুয়েছিলেন।

শ্রীলঙ্কার হয়ে ওয়ানডেতে ১২৬৫০ রান করে তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সবমিলিয়ে জয়াবর্ধনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৪০০০০ এর বেশি রান করেছেন। সাঙ্গাকারার পরে তিনি শ্রীলঙ্কার হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি।

  • অরবিন্দ ডি সিলভা

শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ শিরোপা অর্জনের পেছনের মানুষটি তিনি। শ্রীলঙ্কার হয়ে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সিলভা ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বিশ্বকাপে তিনি শ্রীলঙ্কার হয়ে ৪৪৮ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে তার অপরাজিত ১০৭ রানই শ্রীলঙ্কাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করে।

অরবিন্দ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট  ১৫০০০ রান করেছেন এবং ওয়ানডেতে ১০০ টিরও বেশি উইকেট পেয়েছেন। অদ্যাবধি বিশ্বকাপের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৩ উইকেট নিয়েছেন।  

  • লাসিথ মালিঙ্গা 

মালিঙ্গা সর্বকালের সেরা সীমিত ফরম্যাটের বোলার হিসেবে বিবেচিত। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের পুরো গতিশীলতাই পাল্টে দিয়েছেন মালিঙ্গা। বিশ্ব প্রথমবারের মতো একটি অস্বাভাবিক অ্যাকশন সহ একটি অপ্রথাগত ফাস্ট বোলারকে দেখেছিল। যে কোনো সময় ইয়র্কার বোলিং করার ক্ষমতা তাকে দারুণ সাফল্য এনে দেয়।

ডেথ ওভারের ওস্তাদ বলা হয় মালিঙ্গাকে। মালিঙ্গা ২০১৪ এর টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্কোয়াডের অংশ ছিলো এবং বিশ্বের সেরা টিটোয়েন্টি বোলারদের একজন হিসাবে বিবেচিত হতে পারেন। মালিঙ্গা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টানা ৪ উইকেট নিয়েছেন দুইবার। ৫২৮ টি আন্তর্জাতিক উইকেট রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।

  • চামিন্দা ভাস 

শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাসে তিনিই সেরা ফাস্ট বোলার। তিনি নিখুঁত লাইন- লেন্থ এবং দেরীতে সুইং করে ব্যাটসম্যানদের সমস্যায় ফেলা কৌশলী বোলার ছিলেন। ওয়ানডেতে ৪র্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ভাস। তিনি ৩২২ ম্যাচে ৪০০ উইকেট নিয়েছেন।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮/১৯ নিয়ে ওডিআইতে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ডও তার দখলে। নিচের সারির ব্যাটার হয়েও তিনি তিন সহস্রাধিক রান করেছেন। তাঁর মধ্যে একটি শতক ও ১৩ অর্ধশতক করেছেন। ফিল্ডার হিসেবে তিনি তার শক্তিশালী বাহুর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। ভাস ২০০৪ এবং ২০০৭ এ দুইবার আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে জায়গা করে নেন।

  • অর্জুনা রানাতুঙ্গা 

রানাতুঙ্গা এবং শ্রীলঙ্কা একসঙ্গে তাদের টেস্ট অভিষেক করেছিলেন! তিনি লায়ন্সের হয়ে টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি করা প্রথম খেলোয়াড়ও। আন্ডারডগ থেকে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দলকে ১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ অবধি নেতৃত্ব দিয়ে নেয়ার পথপ্রদর্শক মানা হয় রানাতুঙ্গাকে।

লঙ্কান ক্রিকেটের উন্নতি, তার নির্ভীক নেতৃত্বের জন্য বিখ্যাত তিনি সুপরিচিত। রানাতুঙ্গা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২০০০ রান করেছেন এবং ২০০০ সালে তিনি অবসর নেন। তিনি সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন।

  • মারভান আতাপাত্তু 

মারভান আতাপাত্তু ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের অংশ ছিলেন। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলে খেলেছেন। ১৯৯০ সালে অভিষেক হয় তাঁর।

টেস্ট ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার পক্ষে ৫৫০৪ রান করে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছেন। তিনিকাকতালীয়ভাবে, তিনি লঙ্কানদের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটেও ষষ্ঠতম  সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। আতাপাত্তু ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ওডিআইতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান আউট করা ফিল্ডার ছিলেন।

  • অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস

২০০৮ সালে এই ক্রিকেটারের অভিষেক ঘটে। ৩৫ বছর বয়সী অ্যাঞ্জেলো বিশ্বক্রিকেট এবং শ্রীলঙ্কায় কিছুটা আন্ডাররেটেড। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। অবদানের দিক থেকে সনাথ জয়াসুরিয়ার পরেই তিনি দ্বিতীয় সেরা রাউন্ডার। যদিও, আজকাল বোলিংটা তিনি একদমই করেন না।

ম্যাথুস ১৩,০০০ এর বেশি আন্তর্জাতিক রান করেছেন এবং সব ফরম্যাট মিলিয়ে তাঁর নামের পাশে ১৯১ টি উইকেট রয়েছে। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link