তৌহিদ হৃদয়, হৃদয়ভাঙ্গা গল্পের জমাটবাঁধা সূচনা

এই দিন কয়েক বাদেই ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসছে ইংল্যান্ড। দুই দলের স্কোয়াড চূড়ান্তও হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। তবে বাংলাদেশ স্কোয়াডে বড় চমকটার নাম তৌহিদ হৃদয়। 

সদ্য শেষ হওয়া বিপিএল আসরে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন তৌহিদ হৃদয়। টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে রান করেছেন ৪০৩। যার মধ্যে পাঁচটিতে রয়েছে ফিফটি। অর্ধশতকের সংখ্যায় এবারের বিপিএল যা আর কেউ টপকাতে পারেনি। 

আবার ধারাবাহিকভাবে রান তোলার পাশাপাশি বোলারদের উপর নিজের আগ্রাসনও দেখিয়েছেন প্রায় ম্যাচেই। টুর্নামেন্টে ১৪০ স্ট্রাইকরেট সেই চিত্রের যথার্থতায় প্রমাণ করে। 

দারুণ বিপিএল কাটানো তৌহিদ হৃদয়ের তৃপ্ততা আরো বেড়ে গিয়েছে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ায়। মাশরাফি যদিও সেটাকে একটু ‘তাড়াতাড়ি’ বলছেন। তবে সব কিছু ঠিক থাকলে সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে লাল সবুজ জার্সি উঠতে পারে তৌহিদ হৃদয়ের গায়ে। 

প্রথমে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, এরপর ঘরোয়া ক্রিকেট দিয়ে জাতীয় দলে পদার্পণ। আপাত দৃষ্টিতে সুমসৃণ যাত্রাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তৌহিদ হৃদয়ের জন্য এতদূর পথ পাড়ি দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। প্রতি পদে পদে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। 

সেই যাত্রায় ধাক্কাও খেয়েছেন বেশ ক’বার। তবে প্রথম ধাক্কাটা বড্ড বেশি অসহনীয়। তৌহিদ হৃদয়ের বাবা ক্রিকেট খেলা পছন্দ করতেন না। মা যে খুব করতেন, তা নয়। তবে ছেলের ইচ্ছার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি।

এর মাঝে তৌহিদ হঠাৎই একদিন একটা ক্লাবের সন্ধান পেলেন। কিন্তু সেখানে ঢুকতে লাগবে টাকা। কিশোর মন। তাই এমন প্রলোভনে ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন হৃদয়। জানতেন, বাবাকে বলে কাজ হবে না। তাই মায়ের কাছে খুলে বললেন। মা ছেলের স্বপ্নের কথা ভেবে এগিয়ে এল। একটা জমি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করলেন।

তৌহিদ সেই টাকা ক্লাবকে দিলেন। কিন্তু দিন চলে যায়, মাস যায়- কিন্তু ক্লাবের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। সময় গড়াল অনেকদিন। তৌহিদ হৃদয় বুঝে নিলেন, তিনি এক ভুয়া ক্লাবের খপ্পড়ে পড়েছেন। তাই অনেক টাকা বিফলে গেল হৃদয়ের। হৃদয়ের ক্রিকেটযাত্রার শুরুটাই হলো হৃদয়ভাঙ্গা গল্প দিয়ে। 

হৃদয় চাইলে সেখানেই ভেঙ্গে পড়তে পারতেন। কিন্তু সেটা হয়নি। তৌহিদ হৃদয় উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলেন। সৃষ্টিকর্তার রহমতে সেই যাত্রায় সফলও হলেন। প্রয়াত কোচ মহিউদ্দিনের চোখে পড়লেন তৌহিদ হৃদয়। পরে তিনিই হৃদয়কে অনূর্ধ্ব-১৬ বিভাগে খেলার সুযোগ করে দেন এবং পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৮ এর জন্য মনোনিত করেন।

কিন্তু সেই সুযোগ তেমন কাজে লাগাতে পারলেন না তোহিদ হৃদয়। ব্যর্থ হলেন। হতাশায় ক্রিকেট থেকেই প্রায় দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাতই জীবন বদলে যায় খালেদ মাহমুদ সুজনের সান্নিধ্যে এসে।

খালেদ মাহমুদ সুজন তখন দেশের শীর্ষস্থানীয় কোচ এবং বিসিবির বোর্ড পরিচালক। ঐ সময়ে রাজশাহীতে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি ক্রিকেট একাডেমি বাংলা ট্র্যাক ক্রিকেট একাডেমি পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। তো তাঁর একাডেমিতেই অনুশীলন করতে আসতেন তৌহিদ হৃদয়। 

আর এখানেই কপাল খুলে যায় হৃদয়ের। তাঁর ব্যাটিংয়ে দারুণ এক সম্ভাবনা দেখেছিলেন সুজন। সেই ধারাবাহিকতাতেই সুজনের সুনজরে পড়ে যান তৌহিদ হৃদয়। ব্যাস। এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেললেন, চ্যাম্পিয়ন হলেন। একই সাথে ঘরোয়া ক্রিকেটেও নিজের চেনা ফর্মে এগিয়ে যেতে থাকলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, লিস্ট এ ক্রিকেট- দুই ফরম্যাটেই সমানতালে রান করতে থাকলেন। 

তৌহিদ হৃদয়ের দুর্দান্ত ছন্দের আড়ালের নায়ক আবার মুশফিকুর রহিম। সেই যে ২০১৭ সালে মুশফিকের ব্যাট নিয়ে এক ম্যাচে ৭ টা ছক্কা মেরেছিলেন। এরপর থেকে টুর্নামেন্টে এক দলে থাকলেই মুশফিকের ব্যাট নিয়ে খেলেন তৌহিদ হৃদয়। এবারও তাই হয়েছে। পুরো বিপিএলে তৌহিদ হৃদয় যে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন তার প্রত্যেক ইনিংসই এসেছে মুশফিক রহিমের খেলা ব্যাট দিয়ে। 

তারপরও ব্যাট তো আর এই ছন্দের আসল রহস্য নয়। রহস্যটা হলো হৃদয়ের ব্যাটিং স্ট্যান্স। আগের চেয়ে এবার ভিন্ন স্ট্যান্সে ব্যাট করেছেন হৃদয়। আর তাতে সফলতাও মিলেছে। সাবলীল ব্যাটিং করতে পারছেন, দ্রুত গতিতে রান করতে পারছেন, পাওয়ার হিটিংটাও আয়ত্ত্বে আনতে পেরেছেন।  

আর এমন ধারাবাহিকতার কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেও সুযোগ পেতে বেশি অপেক্ষায় থাকতে হলো না হৃদয়কে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো আর এতটা সহজ নয়। অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার ইতিহাসে পা হড়কেছেন। নিজেকে হারিয়ে খোঁজার মতো দশার সৃষ্টি হওয়ার উদাহরণ অগণিত। 

তৌহিদ হৃদয় নিশ্চয় সে পথে হাটতে চাইবেন না। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন নিজের জায়গা সমুন্নত করাই তাঁর একমাত্র চ্যালেঞ্জ। তবে অতীত বলে, তোহিদ হৃদয় এমন চাপের সাথেই বেড়ে উঠেছেন। এটা মোটেই তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়।  তাই বাংলাদেশের লাল সবুজ জার্সির ভারিক্কিও যে তৌহিদ হৃদয় বইতে পারবেন- তা নিশ্চিত সুরে বলাই যায়। 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link