একটি গোল, ১২ টি বুলেট!

এসকোবারের এই বোঝানোয় কোনো কাজ হয়নি।  পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের পিস্তল থেকে মোট ১২ টি গুলি এসকোবারকে ভেদ করে চলে যায়।  প্রতিটা গুলি করে ধারাভাষ্যকারদের মত চিৎকার করে আততায়ীরা ‘গোল… গোল’ বলে চিৎকার করতে থাকে। রক্তাক্ত এসকোবারকে রেখে একটা টয়োটা পিকআপ ভ্যানে করে তারা পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ এসকোবার হাসপাতালে পৌঁছানোর ৪৫ মিনিট পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ। মাতিয়াস ইউরিব এবং কারলোস বাক্কা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচে পেনাল্টি শুট আউটে কেবল এই দুই কলম্বিয়ানই গোল মিস করেছেন। আর তাতেই বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া নিশ্চিত হয়ে যায় তাঁদের।

ব্যস, তাতেই শুরু। সোশ্যাল মিডিয়ায় হত্যার হুমকি পেতে শুরু করেন খেলোয়াড়রা। জীবনের ওপর এমন ঝুঁকি যে নেমে আসবে সেটা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন সাচি। বলেছিলেন, ‘একজন ভাই হিসেবে আমি এই যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। জানি না ওদের মগজে কি চলছে, শুধু চাইবো না আমাকে যা সহ্য করতে হয়েছে একই রকম কিছু ওদেরও সহ্য করতে হোক।’

ইকুয়েডরের ক্লাব ইউনিভার্সিদাদ ক্যাটোলিকার কোচের দায়িত্বে থাকা সাচি বেশি ভয় পাচ্ছিলেন গোলরক্ষক কার্লোস সানচেজের জন্য। বলছিলেন, ‘কার্লোস নিশ্চয়ই ভুলের জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে, সাথে নিজের ও পরিবারের জন্য ভয়ও পাচ্ছে। আমার ভাইকে কেউ কখনো হুমকি দেয়নি, শুধু কাপুরুষের মত ওকে গুলি করেছিল। এখন চাইলে লোকে সোশ্যাল মিডিয়াতেই জীবন নেওয়ার হুমকি দিয়ে ফেলতে পারে। সময়টা এখনও একই রকম আছে। আন্দ্রেসের মৃত্যু থেকে কেউ কোনো শিক্ষা নেয়নি।’

কে এই আন্দ্রেস? আন্দ্রেস পরিচিত ছিলেন ‘দ্য জেন্টেলম্যান অব ফুটবল’ নামে। পুরো নাম আন্দ্রেস এসকোবার সালদারিয়াগা।

২১ বছর বয়সে ৩০ মার্চ ১৯৮৮ সালে কানাডার বিপক্ষে অভিষেক হয়। কলম্বিয়া ম্যাচটিতে ৩-০ গোলে জয়লাভ করে। ১৯৮৮ সালে রিউস কাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একমাত্র আন্তর্জাতিক গোল করেন। ম্যাচটা ড্র হয় ১-১ গোলে।

১৯৮৯ সালে কোপা আমেরিকাতে ২২ বছর বয়সে চারটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান, তার দল কলম্বিয়া যদিও প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয়। এই বছরের ১৯৯০ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে কলম্বিয়া প্লে অফ জিতে মূল পর্বের টিকেট পায়। দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে রজার মিলার ক্যামেরুনের কাছে ২-১ গোলে হেরে বিদায় নেয়।

এসকোবার ১৯৯১ সালের কোপা আমেরিকাতে সাতটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে সুযোগ পাননি তিনি। যদিও, বিশ্বকাপে তাকেই অধিনায়ক করে বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণা করা হয়।

গ্রুপ ‘এ’র ম্যাচে রোমানিয়ার বিপক্ষে  ১-৩ গোলের হার দিয়ে শুরু করে কলম্বিয়া। দ্বিতীয় ম্যাচ আমেরিকার বিপক্ষে। ১৯৯৪ সালের ২২ জুন সেই ম্যাচে ৩৪ মিনিটে আমেরিকান মিডফিল্ডার জন হার্কসের ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে আত্নঘাতী গোল করে বসেন এসকোবার। খেলায় কলম্বিয়া ১-২ গোলে হেরে যায়। দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার জন্য জয়, অন্তত ড্র করার বিকল্প ছিল না কলম্বিয়ার।

শেষ ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় তাই কোনো কাজেই আসেনি কলম্বিয়ার। কে জানতো, এটাই হয়ে রইবে এসকোবারের ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ক্যারিয়ারে ৫১ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন, এর মধ্যে মাইলফলকের ৫০ তম ম্যাচটাই এসকোবারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত ম্যাচ। এই ম্যাচের জন্যই যে প্রাণ হারান তিনি।

বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের ৫ দিন পরে দেশে ফিরে আসেন। পরিবারের সাথেই সময় কাটাচ্ছিলেন। ১৯৯৪ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যায় কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হয়। তারা মেডেলিনের কাছেই ‘এল পাব্লাডো’ নামের একটি বারে যান। সেখান থেকে আনুমানিক রাত তিনটায় বের হয়ে বন্ধুরা যে যার মত বাড়ির পথ ধরেন।

এসকোবার পার্কিং লটে গাড়িতে ওঠার সময় তিনজন দুষ্কৃতিকারী পথরোধ করে এবং অযথা তর্ক জুড়ে দেয়। এসকোবার নিজেও যথেষ্ট সতর্ক হয়ে যান। এসকোবার বারবার তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, যে ভুলটি তিনি করেছেন তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।

এসকোবারের এই বোঝানোয় কোনো কাজ হয়নি।  পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের পিস্তল থেকে মোট ১২ টি গুলি  এসকোবারকে ভেদ করে চলে যায়।  প্রতিটা গুলি করে ধারাভাষ্যকারদের মত চিৎকার করে আততায়ীরা ‘গোল… গোল’ বলে চিৎকার করতে থাকে।

রক্তাক্ত এসকোবারকে রেখে একটা টয়োটা পিকআপ ভ্যানে করে তারা পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ এসকোবার হাসপাতালে পৌঁছানোর ৪৫ মিনিট পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ফুটবলের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে ট্র্যাজেডিক, সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা। ঘটনাটা ফুটবল বিশ্বকাপে শোকে, ভয়ে পাথর করে দেয়।  এসকোবারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এক লাখ বিশ হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। সতীর্থের মৃত্যুর পর দলের অন্যতম তারকা ভালদেরামা ও অ্যাসপিরিলা ২০ জন দেহরক্ষী নিয়োগ দেন।

আশির দশক থেকে কলম্বিয়ান ফুটবল কে বিভিন্ন সময়ে অর্থায়ন করেছিল অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীরা। এই সময়ে প্রচুর ফুটবলার উঠে আসে, সাফল্যও আসতে শুরু করে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে এক ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৫-০ গোলে হারিয়ে প্রত্যাশার পারদ কে অনেক উপরে নিয়ে যায়।

বিশ্বকাপে তাই কলম্বিয়াকে নিয়ে অনেক আশা ছিল। তাদের ‘ডার্ক হর্স’ বলেও মনে করছিলেন অনেকে। আমেরিকার বিপক্ষে ম্যাচটিতে বাজির দরও ছিল কলম্বিয়ার পক্ষে। কিন্তু, কলম্বিয়া হেরে যাওয়ায় অনেক বাজিকরদের কোটি কোটি ডলার লোকশান হয়। তারই বদলা হল এসকোবারের প্রাণনাশ।

১৯৯৫ সালে এসকোবারকে হত্যার দায়ে হাম্ভের্তো ক্যাস্ট্রো মিউনোজ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর সাথে মাদক ব্যবসায়ী পিটার ডেভিড ও হুয়ান সান্তিয়াগোর যোগাযোগ ছিল। আদালত এসকোবারকে হত্যার জন্য এই ব্যক্তিকে ৪৩ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। কিন্তু, দু:খজনক হলেও সত্য মুনোজ মাত্র ১১ বছর জেল খেটেই মুক্তি পেয়ে যান।

এসকোবারের জন্ম হয়েছিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন একজন ব্যাংকার, বড় ভাই সাচি সাবেক ফুটবলার। অন্য সবার মত এসকোবারও ছোট থেকেই ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন পূরণও হয়েছিল, স্থায়ী হয়নি।

ব্যক্তি জীবনে তিনি ইন্সটিটিউট অব কর্নাডো গঞ্জালেজের স্নাতক ছিলেন। মৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস আগে পামেলা ক্যাসকার্ডোর সাথে বাগদান সম্পন্ন হয়েছিলো, যিনি পেশায় একজন ডেন্টিস্ট ছিলেন।

ইতালিয়ান জায়ান্ট ক্লাব এসি মিলানের সাথে কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বকাপ শেষেই দলটিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। ফুটবলার হিসেবে হয়তো আরও ওপরে উঠতেন, কিন্তু ফুটবল বিধাতা ভাগ্যে লিখে রেখেছিল অন্য কিছু!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...