কিলিয়ান এমবাপ্পে, ফাইনালের ট্র্যাজিক হিরো

প্রতিটি উপন্যাসেই থাকেন হিরো, যিনি লাইমলাইটে থাকেন; যাকে নিয়ে হয় আলোচনা। গল্পের শেষে সব বন্দনা থাকে তাঁর জন্যই। আর কিছুটা আড়ালে তখন মুখ ঢেকে কেউ হয়তো গোপনে দু’ফোটা চোখের জল ফেলেন, তিনি সেই উপন্যাসের ট্র্যাজিক হিরো; ভাগ্যের মারপ্যাচে তাঁর শেষটা হয় বিষন্নতায় ভরা। লিওনেল মেসি কিংবা অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া যদি হউন কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ নামক উপন্যাসের হিরো, তবে নি:সন্দেহে ট্র্যাজিক হিরোর আসনে থাকবেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।

বয়সটা মাত্র চব্বিশ বছর; সমবয়সী ফুটবলাররা মাত্র প্রতিভাবান থেকে পারফর্মার হয়ে উঠছেন। কিন্তু কিলিয়ান এমবাপ্পে এই বয়সেই সময়ের সেরা ফুটবলারের বিতর্কে নাম লিখিয়েছেন। কেন এমবাপ্পে এগিয়ে আছেন বাকিদের চেয়ে, সেটিরই একটি প্রদর্শনী হয়েছে এবারের বিশ্বকাপ ফাইনালে। দলকে একাই টেনে নিয়েছেন লড়াইয়ের শেষ পর্যন্ত; কিন্তু সতীর্থদের ভুল কিংবা ভাগ্যের পরিহাসে পরাজিতদের খাতাতেই লেখা হয়েছে তাঁর নাম।

পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে দারুণ খেলতে থাকা আঁতোয়ান গ্রিজম্যান ফাইনালে ছিলেন ম্লান, একই কথা বলা যায় স্ট্রাইকার অলিভার জিরুদের জন্যও। আক্রমণভাগে নিজের ইন ফর্ম দুই সঙ্গীকে হারিয়ে কিলিয়ান এমবাপ্পে তখন খোলসবন্দী। অন্যদিকে ফরাসি দুর্গে ততক্ষণে দুইবার তখন ঢুকে পড়েছিল আর্জেন্টাইনরা, ম্যাচের স্কোরলাইন ২-০।

ঘড়ির কাঁটা যখন পেরিয়ে গিয়েছে ৭৫ মিনিটের ঘর, আর্জেন্টিনার ভক্ত-সমর্থকরা তখন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল উদযাপনের। কিন্তু তারুণ্যের উদ্দীপনায় ভরা কিলিয়ান এমবাপ্পের রক্তে তখন বেজে উঠেছিল – ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্রু মেদিনী’। স্রেফ হার না মানার মানসিকতার জোরেই হয়তো মাত্র ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে জোড়া গোল করে দলকে ম্যাচে ফেরান এই পিএসজি ফরোয়ার্ড।

প্রথম গোল ছিল পেনাল্টি থেকে, সেখানে কিলিয়ান এমবাপ্পের স্নায়ুর জোরই বেশি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু দুর্দান্ত ভলিতে করা দ্বিতীয় গোলে দেখা গিয়েছে তাঁর ফুটবলীয় দক্ষতা আর আত্মবিশ্বাসের মিশেল। সতীর্থ মার্কাস থুরামের চিপ করা বলটি কাছাকাছি আসা মাত্রই কালক্ষেপণ না করে নিজের ডান পা ছুড়ে দেন। দুর্দান্ত ছন্দে থাকা এমিলিয়ানো মার্টিনেজও থামাতে পারেননি সেই ভলি; মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানেই ভাঙা স্বপ্ন জোড়া লাগে ফরাসিদের।

নাটকীয়তার তখনো শেষ হয়নি। অতিরিক্ত সময়ের ১৮ মিনিটে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের উল্লাসে তখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল শিরোপা জয়। কিন্তু আবারো দৃশ্যপটে হাজির হন এমবাপ্পে; তাঁর শট নিকোলাস মন্টিয়েলের হাতে লাগলে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স।

স্পট কিক থেকে গোল করতে এবারও ভুল হয়নি চব্বিশ বছর বয়সী এই তারকার, ম্যাচে সমতা আনার পাশাপাশি মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড গড়েন তিনি।

টাইব্রেকারেও নিজের শটে ঠিকই গোল করেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। কিন্তু আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক কিংসলে কোম্যান এবং অরেলিয়েন শুয়েমেনির শট ঠেকিয়ে দিলে শেষ হাসি হাসতে পারেননি এমবাপ্পে। অবশ্য টুর্নামেন্টে আট গোল করে গোল্ডেন বুট নিজের করে নিয়েছেন তিনি। যদিও বিশ্বকাপ হারানোর শোকের কাছে এই প্রাপ্তি তুচ্ছই মনে হবে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী এই তরুণের কাছে।

নতুন মৌসুমের শুরু থেকেই আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। বিশ্বকাপেও ধরে রেখেছিলেন সেই ধারাবাহিকতা; ফাইনালের আগ পর্যন্ত পাঁচ গোল আর দুই অ্যাসিস্ট করেছিলেন তিনি। আর শিরোপা নিষ্পত্তির দ্বৈরথে একাই লড়েছেন, হ্যাটট্রিক করেছেন এই স্ট্রাইকার। সবমিলিয়ে তারকাবহুল ফ্রান্স দলের সেরা পারফর্মার এমবাপ্পে।

সাধারণ কোন ভক্তের মতই কিলিয়ান এমবাপ্পে হয়তো মনের কোণে লালন করেছেন আরো একবার বিশ্বকাপ জেতার কিন্তু তীরে এসেও ডুবেছে ফরাসি জাহাজ। তরুণ নাবিক এমবাপ্পে তাই মুষড়ে পড়েছেন বেদনায়। ভাগ্যের একটু ছোয়া পেলে কিংবা ১২৩ মিনিটের মাথায় কোলো মুয়ানির শট জালে জড়ালে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটা নিজের করে পেতে পারতেন এই সুপারস্টার।

আর্জেন্টিনা তাদের লড়াইটা ফ্রান্সের সাথে নয়, লড়েছে কিলিয়ান এমবাপ্পের সঙ্গে। ওয়ান ম্যান আর্মির মতই এমবাপ্পে চেষ্টা করেছেন, সফলও হয়েছেন কিন্তু শেষ প্রলেপটা আর দেয়া হয়নি। তাই ট্র্যাজিক হিরো হয়েই রইলেন তিনি।

২০১৪ সালে মারাকানায় বিষন্ন লিওনেল মেসির ছবিটা কিলিয়ান এমবাপ্পের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার উৎস। আট বছর আগেরকার সেই পরাজয় মেসিকে যেভাবে আরো ক্ষুরধার করে তুলেছে, যেভাবে তাঁর জয়ের ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়েছে; এমবাপ্পেও এখন থেকে ঘুরে দাঁড়াবেন, আরো দুর্দমনীয় হয়ে উঠবেন। বহু বছর পর কিলিয়ান এমবাপ্পের ক্যারিয়ারের এই দাগটিই হয়তো তাঁকে আরো মহিমান্বিত করবে, তাঁর জীবনের গল্পকে করবে আরো রোমাঞ্চকর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link