গাজ্জা! ট্র্যাজিক কিংবা ট্যাবলয়েড হিরো!

আলতো আঁচড়ে শেষ রঙটুকু জুড়ে দিলেন। ব্যাস, তাতেই তৈরি দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম। একটা সময় ফুটবল যেন ছিল তাই। আপনি যতই দেখবেন ততই চোখ জুড়িয়ে যাবে। এখন তো রীতিমত আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শৈল্পিক ফুটবল খুঁজে পাওয়া দায়। আর এই তো আশি-নব্বই দশকেও তো মিলত মনোমুগ্ধকর এক একটি চিত্রকর্ম।

সে সময় পল গ্যাসকোয়েনরা ছিলেন বলেই ফুটবল ছিল চোখের প্রশান্তি। তবে, যার কথা বলছি, তিনি নব্বই দশকের ফুটবল অঙ্গনের খুবই আলোচিত এক সমালোচিত চরিত্র। বিশেষ করে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো চোখের মণি বা চোখের বিষ হতেন প্রায়ই। ‘গাজ্জা’ ডাক নামটাও তখন থেকেই গ্যাসকোয়েনের সঙ্গী।

গ্যাসকোয়েন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপও খেলেছিলেন। জন্মেছিলেন ২৭ মে ১৯৬৭ সালে। তবে ট্যাজিক জীবনের শুরুতেই তিনি প্রথম ধাক্কা খেয়েছিলেন। ধাক্কাটা ছিল মানসিক। বাল্যকালেই নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে তিনি মরতে দেখেছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। তার সেই ছোট্ট হাতগুলোতেই শেষবার নি:শ্বাস নিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু। জীবনের শেষভাগে চলে আসা এই ফুটবলারকে এখনও ভাবায়, কাঁদায় সেই ঘটনা।

তার মানসিকতায় বেশ একটা প্রভাব ফেলেছিল সে ঘটনা। তবে তা যেন গ্যাসকোয়েনের ভেতরে থাকা ফুটবলীয় সত্ত্বার বিকাশকে বিন্দুমাত্র আটকে রাখতে পারেনি। ফুটবল প্রতিভার অঙ্কর ক্রমশ একটা দৈত্যাকার বটবৃক্ষ হয়েছে। ফুটবল খেলাটা ছেলে বেলা থেকেই। ‘স্কুলবয়’ প্রোগ্রাম থেকেই নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের সাথে সখ্যতা তার। দ্রুতই শিল্পী সত্ত্বা সামনে আসতে থাকে।

নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের হয়েই তিনি শুরু করেন নিজের ক্লাব ক্যারিয়ার। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমেই তিনি ক্যালেস সেনানী হলেও মূলত ম্যাচ খেলার সুযোগ পান পরের মৌসুম থেকে। উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হতে শুরু করা। মধ্যমাঠের এই খেলোয়াড় ছিলেন নান্দনিক। তার খেলা দেখাটা যেন ছিল বিনোদিত হওয়া অন্যতম সেরা উপজীব্য। ক্রমশ বর্ধমান বটবৃক্ষ হয়ে তিনি মধ্য মাঠের ছায়া হয়ে যেতে সময় নিলেন না খুব বেশি।

এর মধ্যে নিউক্যাসেলের হয়ে যখন ক্যারিয়ার প্রায় শেষ হবে হবে দশা, ঠিক সে সময়েই তিনি ডাক পান ইংল্যান্ড জাতীয় দলে। মাত্র দুই বছরের মাথায় বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়ে যান তিনি। একজন ফুটবলারের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন বিশ্বকাপে নিজ দেশের হয়ে খেলতে পারা। আর মাত্র ২২ বছর বয়সেই সে সুযোগ এসে যায় গ্যাসকোয়েনের। মধ্য মাঠের কাণ্ডারি হতে যা গুণ প্রয়োজন তার সবই ছিল তার মধ্যে।

তবে আফসোস সেমিফাইনালে সেবার হেরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। তবে এর আগেই হলুদ কার্ড দেখেন গ্যাসকোয়েন। আর এরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সেটা অবশ্য বিশ্ব গণমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলেছিল। ফুটবলটা যে আবেগের পুরোটা জুড়েই বসবাস করে সে বিষয়টাই যেন আরও একটিবার সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন পল গ্যাসকোয়েন। কেননা যদি সেবার সেমিফাইনাল ম্যাচ জিতে যেত তবে ফাইনাল খেলা হত না গ্যাসকোয়েনের কার্ড জটিলতায়।

তবে তিনি একজন ট্র্যাজিক হিরোই বটে। ফুটবলার হিসেবে সর্বকালের সেরাদের একজন হওয়ার মোটামুটি সব গুণাবলিই ছিল তার। তবে মদ্যপানের আসক্তি তার সেই সম্ভাবনাকে যেন খানিক স্তিমিত করে দিয়েছিল। তিনি বারেবারে চেষ্টা করেছেন ফিরে আসতে মাদকের কাল থাবা থেকে। তবে ইংলিশ গণমাধ্যম যেন তার সেই পথ  অবরুদ্ধ করতে বদ্ধ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। তিনি যতটা না ঘটাতেন তার থেকে বেশি রটাত ইংলিশ মিডিয়া।

মানসিক এক ট্রমা তো ছিলই ছোটবেলায়। সেই সাথে নতুন করে যুক্ত হওয়া গণমাধ্যমের এক অদৃশ্য অত্যাচার। আর মদের প্রতি তার টান সব মিলিয়ে মানসিক টানাপোড়েনের মাঝে তিনি যেন আটকে যেতেন, থমকে যেত জাতীয় দলে ক্যারিয়ার। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো চাইলেও সেই দায় এড়াতে পারে না কোনো ভাবে।

দলের বাইরে থাকা আবার দলে ফেরা এমন করেই চলতে থাকে তার ক্যারিয়ার। তবে এই সমস্যার কারণেই ক্যারিয়ারের শেষ ভাগটায় মাধুর্যটা ছিল না। কেমন যেন এলোমেলো ভাবেই ক্যারিয়ার সমাপ্তির পথে হাঁটেন ফুটবলের এই ট্র্যাজিক হিরো। আজকাল আর তাঁকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link