রোমন্থন – ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্ট ২০১৩

১৪ জুলাই ২০১৯। ক্রিকেটের পঞ্জিকায় ‘রেড লেটার ডে’। বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা বলছি আর কি। মনে আছে, কনসিউমার বিহেভিয়ার পরীক্ষা ছিল ঠিক পরেরদিন। চরম কঠিন বিষয়, কিন্তু হোস্টেলের ঘরে একসাথে দশ বারো জন মিলে ‘ফিকার কো ধুঁয়া মে’ উড়িয়ে বল বাই বল দেখেছিলাম খেলাটা।

পরীক্ষার ফল কি হয়েছিল সেটাও অবশ্য কহতব্য নয়। কিন্তু এই লেখার বিষয় ওই ম্যাচ নয়। তার ঠিক ৬ বছর আগে, আজকেরই দিনে ঘটে যাওয়া একটি টেস্ট ম্যাচ, এই লেখার বিষয়। ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের রেশ সদ্য শেষ হয়েছে। সেবার ইসিবি ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ঠিক করেছিল, টানা দশ ম্যাচের অ্যাশেজ সিরিজ খেলবে। ৫ টা বিলেতে, বাকি ৫ টা অস্ট্রেলিয়ায়।

এই টেস্ট ছিল সেই সিরিজের প্রথম টেস্ট। এতরকম চিত্রকল্প রয়েছে সেই ম্যাচ ঘিরে, অথচ রোমন্থিত হয় কই? জেমস অ্যান্ডারসনের অনবদ্য বলে ক্লার্কের বোল্ড, আস্টন আগারের এগারো নম্বরে নেমে ৯৮, স্টুয়ার্ট ব্রডের আউট নিয়ে বিতর্ক, ডি.আর.এস বিতর্ক-কত কত স্মৃতি সেই ম্যাচের, এবং আমার কাছে এখনো খুব টাটকা। শুরু থেকেই শুরু করি।

জীবনে বহুরকম অস্ট্রেলিয়া দল দেখেছি। কোনোটা খুব শক্তিশালী, কোনোটা খুব দুর্বল। কিন্তু মাঠ ও মাঠের বাইরে এমন কলহ জর্জরিত দল কখনো দেখিনি। তুলনায় আসতে পারে একমাত্র ২০১৮ সালে স্যান্ডপেপার বিতর্ক পরবর্তী অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেবার একটাই বিতর্কের গ্যাসে পুরো দল বিষাক্ত হয়ে পরে। ২০১৩ সালের মতো রকমারি বিতর্কের দোকান সে দল নয়।

লন্ডনের একটি পাবে ‘ঈষৎ মত্ত অবস্থায়’ জো রুটকে ‘প্রহার’ করে বসেন। ফলত প্রথম টেস্টের দল থেকে বাদ। শেষমেষ ইংল্যান্ডেই কাউন্টি খেলা ক্রিস রজার্সকে নিতে বাধ্য হয়, যিনি কিনা গত ৬ বছর টেস্ট দলের বাইরে। ওয়েটিং লিস্ট দূরের কথা, সম্ভাব্য ওপেনারদের স্টেশনেই তাঁর টিকি পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। শুধু ভদ্রলোক ভালো সুইং খেলতেন বলে, এবং এতদিন ডার্বিশায়ারে খেলছেন বলে দলে জায়গা পেলেন ৩৬ বছর বয়সে।

প্যানিক মিটারে টকটকে লাল না হলে, অস্ট্রেলিয়ার সাধারণত এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেয় না বলেই জানি। এরপর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ল্যাজে গোবরে। মিকি আর্থারের হেড্মাস্টারসুলভ আচরণ সেসময় বহু খেলোয়াড়ই সহ্য করতে পারছিলেন না। ভারত সফরে তার কয়েকমাস আগেই হোম-ওয়ার্ক বিতর্ক হয়ে গেছে। তার রেশ তখন গনগনে না হলেও হাতে-গরম তো বটেই। অত:পর, আর্থারের চাকরি নট। তড়িঘড়ি ড্যারেন লেহম্যানকে নিয়োগ। ইয়ান বোথাম বোধহয় বলেছিলেন, এই অস্ট্রেলিয়াকে ইংল্যান্ড অন্তত ৮-০ হারাবে।

বোথামের বক্তব্যের অবশ্য কারণও কিছু কম ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা দল তখন কুকের ইংল্যান্ড। কয়েকমাস আগেই ভারত থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফিরেছে। স্ট্রাউস অবসরে যাওয়ায় পিটারসেন তখন স্বমহিমায়। চাপবিহীন দূর্দান্ত খেলছেন। উপরন্তু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির রানার-আপ। তা এই ইংল্যান্ড জিতবে না তো কে জিতবে? ২০১০-১১ তে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ হাতছাড়া করার কাটা ঘায়ে, নুনের ছিটে দেবার এতো বড়ো সুযোগ, কোনো ইংরেজ ক্রিকেটার ছাড়েন? সমস্যা সেই সিরিজে একটাই।

ওপেন কে করবেন? স্ট্রাউসের পর কুকের গণ্ডাখানেক ওপেনার সঙ্গী এসেছেন আর গেছেন। এবার কে? সেরকম কাউকে পাওয়া না যাওয়ায়, রুট ওপেন করেছিলেন সেই সিরিজে কুকের সাথে। ভালো উইকেটে টস জিতে ইংল্যান্ড ব্যাট নিয়েছে, মানেই অন্তত ৪৫০র আগে দান ছাড়া যাবে না। ধারাভাষ্যকাররা এমনই নানান কথা বলছিলেন। কিন্তু বজ্রপাত কখন কোথা দিয়ে আসে, কেই বা বলতে পারে? ইংল্যান্ড শেষ মাত্র ২১৫ রানে। এবং মনে আছে, ট্রটের একটা পরিষ্কার লেগ বিফোর, তৎকালীন দুর্বোধ্য ডিআরএসের ফাঁদে নাকচ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও।

ঠিক এখানেই, অধিনায়ক ক্লার্কের প্রতি বহু প্রাক্তন অজি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। মধ্যবিত্ত পুঁজি নিয়েও, যে লড়াই করা যায়, খানিকটা ক্লার্কের পূর্বসূরি বর্ডারের মতই তিনি বারবার দেখিয়ে গেছেন। তবে ওই ২১৫ অবশ্য অ্যান্ডারসন ও ব্রডের জুটির কল্যানে অস্ট্রেলিয়ার কাছে রানের সমুদ্র মনে হচ্ছিলো। অ্যান্ডারসন যে বলে ক্লার্ককে বোল্ড করেন, জানিনা ক্রিকইনফো সেটাকে এই শতাব্দীর সেরা কুড়িটা বলের মধ্যে রেখেছে কি না? না রাখলে মনে হয় অন্যায় হবে।

থ্রি কোয়ার্টারে পিচ করে ভিতরে আসতে আসতে, শেষ সময়ে হালকা বাঁক খেয়ে অফস্টাম্প উড়িয়ে দেয়। এবং মনে রাখতে হবে ক্লার্ক তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাট। শেষ দশ টেস্টে ৭৫.০৬ গড়ে ১২০০ রান। একসময় অস্ট্রেলিয়া ১১৭ রানে ৯ উইকেট।

এবং ঠিক এখানেই এই টেস্টের মাহাত্ম্য, যে যখন যেটাকে সাধারণ ঘটনা বলে মনে হবে, ঘটবে ঠিক তার উল্টো কিছু। এমনিতে আস্টন আগের এগারো নম্বর নন। কখনো ছিলেন না। কাজেই ওই ৯৮ রান রেকর্ড হলেও, ম্যাকগ্রা বা ওয়ালশ বা ক্রিস মার্টিন করলে, যতটা অবাক হওয়া যেত ততটা যাচ্ছে না। কিন্তু চমকপ্রদ তো অবশ্যই। অধুনা মৃত ফিল হিউগসের সাথে জুটি বেঁধে, কি আশ্চর্য্য, অস্ট্রেলিয়াকে ৬৫ রানের লিড উপহার দিলেন।

এরপর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসেও যখন ভরাডুবি, এবং একা বেল লড়ছেন (এই অ্যাশেজ কে অনেকে বেলের অ্যাশেজ ও বলে), সেই সময় ব্রডের সেই প্রায় ব্যাটের মাঝখান দিয়ে মেরেও দাঁড়িয়ে থাকার ঘটনাটি ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার পুঁজিতে রিভিউ ছিল না। এবং ওই জুটি ইংল্যান্ডকে ৩১০ রানের লিড পাইয়ে দেয়। বব উইলিস ব্রডকে চোর চিটিংবাজ অনেক কিছু বলেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, ব্রড কিছু ভুল ওখানে করেননি। যাই হোক, শেষ অঙ্কে ঢুকে যাই। ৩১১ তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া একসময় ২৩১ রানে ৯ উইকেট।

সেখান থেকে ২০০৫ এর এজবাস্টন মনে করানোর মতো খেলা শুরু করেন ব্র্যাড হ্যাডিন ও জেমস প্যাটিনসন। ২০০৫ এর এজবাস্টন না ১৯৯৪ এর করাচি বা ২০১০ এর মোহালি-কোনটার প্রায় রিপিট টেলিকাস্ট হবে,সেই নিয়ে দোলাচলের মাঝে অ্যান্ডারসন হ্যাডিনকে আউট করে দেন। অস্ট্রেলিয়া থেমে যায় ১৫ রান দূরে। এজবাস্টনেও যেমন কাস্প্রবীজ এজ করার সময়, তাঁর হাত ব্যাটের হ্যান্ডেলে ছিল কি না, এই প্রশ্ন ওঠে, হ্যাডিনের ব্যাটেও বল লেগেছিলো কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা উচিত।

সেই অ্যাশেজ এরপর ৩-০ ফলে জিতে যায় ইংল্যান্ড। কিন্তু লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট ছাড়া প্রতিটায়, অস্ট্রেলিয়া দারুন লড়াই করে। এবং হয়তো ট্রেন্টব্রিজের সেদিনের লড়াই থেকেই ক্লার্ক সাহেব ইংরেজ নিধনের জ্বালানি আমদানি করেন। যা পরে নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ পেট্রল-রুপি জনসন হয়ে, ইংরেজদের জ্বালিয়ে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link