অনাড়ম্বর দলবদলে আড়ালের কষ্ট

এক অক্টোবর থেকে ফুটবলে আগামী মৌসুমের দলবদলের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। তার আগে ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচ খেলে বসুন্ধরা কিংস। তার আগে থেকেই আগাম দলবদল শুরু হয়। চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসকে টেক্কা দিতে কিছুটা আগেভাগে মাঠে নামে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র। তবে সবচেয়ে বড় চমকটা দেখাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন দলটি।

আবাহনী লিমিটেড থেকে সোহেল রানাকে প্রথমবারের মতো দলে টানতে যাচ্ছে তারা। পারিশ্রমিকটা শুনলে অনেকেরই চোঁখ কপালে ওঠে যাবে। ৯০ লাখ টাকায় জাতীয় দলের এ মিডফিল্ডারকে দলে ভেড়ানোর সব চুড়ান্ত করেছে বসুন্ধরা। অথচ সম্প্রতি শেষ হওয়া প্রিমিয়ার ডিভিশন হকির দলবদল নিয়ে খেলোয়াড়দের আক্ষেপের শেষ নেই।

সেরা দল গড়ে শিরোপা লড়াইয়ে থাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডই নাকি পুরো দল গড়তেই খরচ হয়েছে ৭০-৭৫ লাখ টাকা! সে হিসেবে হকি খেলৈায়াড়রা যে কতটা অসহায় অবস্থায় রয়েছে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তারওপর তিন বছরেরও বেশি সময় পর দলবদল অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পারিশ্রমিক রয়েছে ঠিক আগের জায়গাতেই। সবাই না বললেও কেউ কেউ মনের কোণে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথাও বলে পেলেছেন।

অথচ একটা দলবদল নিয়ে কয়েক প্রস্ত নাটক মঞ্চস্ত হয়েছে। সেখানে নায়ক কিংবা খলনায়ক যাই বলা হোক না কেন সেটা সারোয়ার মুর্শেদ শাওন। তাকে নিয়ে মোহামেডান-মেরিনারের মধ্যে হামলা করে খেলোয়াড় ছিনিয়ে নেওয়ার পর মামলাও হয়েছে। দলবদলের সময় রাজধানীর গুলিস্তানের ব্যস্ততম ওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম সড়ক বেশ কিছুটা সময় ব্যস্ত ছিল।

সেখানে মোহামেডান যখন দলবদল করে তখন তাদের সমর্থকদের দখলে চলে গিয়েছিল। বেশ কয়েকজন সমর্থক নিয়ে ব্যস্ত জনপদ আটকে দলবদল করেছে মোহামেডান! যদিও এর আগে দলবদলের প্রথম দিনেই বনানীর এক রেস্টুরেন্টে ছয় খেলোয়াড়ের দলবদল সেরেছিল সাদা-কালো প্রতিনিধিরা। এরপর ১০ খেলোয়াড়ের নাম নিবন্ধন করিয়েছে দলটি। এভাবেই আবাহনী লিমিটেড-মেরিনার ইয়াংসের মতো দলগুলো দলবদল সম্পন্ন করেছে।

মোহামেডানের সঙ্গে ফেডারেশনে এসেছিলেন তরুণ আর আলোচিত খেলোয়াড় সারোয়ার মুর্শেদ শাওন। তাঁকে কেন্দ্র করেই দলবদলের ইয়াং মেরিনারের সঙ্গে দ্বন্ধে জড়িয়েছে মোহামেডান। মোহামেডান ম্যানেজার আরিফুল হক প্রিন্সই জানিয়েছেন, মোহামেডানের পুরো দলবদলের খরচ হয়েছে অর্ধ লাখ আর কোটি টাকার মাঝামাঝি। অথচ কি আড়ম্বরভাবেই না দলবদলের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছে দলগুলো।

অনেকেই এটাকে মূল্যায়ন করেছেন, আলোর নিচে অন্ধকার হিসেবে। অথচ দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন ফুটবলার বছরে ক্লাব থেকে ৬০-৬৫ লাখ টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে কেউ কেউ ক্লাব থেকে ৫০-৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ পেয়ে থাকেন এক মৌসুমের জন্য। তুলনায় দেশের তৃতীয় প্রধান আর জনপ্রিয় খেলা হকিতে পারিশ্রমিককে যৎ সামান্যই বলতে হবে।

ঢাকার প্রিমিয়ার ডিভিশন হকি লিগ এমনিতেই অনিয়মিত। ৩ বছর পর হওয়া হকির দলবদলে এবার সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ১০ লাখ টাকাও ছু’তে পারেনি কেউ। সর্বোচ্চ ৯ লাখ টাকায় আবাহনী লিমিটেড থেকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন জাতীয় দলের তারকা ডিফেন্ডার আশরাফুল ইসলাম। এটাই এবারের দলবদলে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক হিসেবে রেকর্ড গড়েছে।

যারা নিয়মিত জাতীয় দলে খেলছেন তাদের মধ্যে আবার সবর্নিশ্ন পারিশ্রমিক উঠেছে তিন লাখ টাকারও নিচে। মেরিনার ইয়াংস ক্লাবের বেশ কয়েকজন নবীন খেলোয়াড় আড়াই লাখ টাকা করে পেয়েছেন এবার। এই হাতে গোনা খেলোয়াড়ের কথা বাদ দিলে আলোচনার বাইরে থাকা হকি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের সামগ্রিক ছবিটা যে কতটা করুণ সেটা অনেকটাই পরিস্কার। দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ারী ক্লাবের খেলোয়াড়েরা তো ৩০-৩৫ হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক নিয়ে। একটা মৌসুম খেলার জন্য চুক্তিবন্ধ হয়েছেন! সে হিসেবে খেলোয়াড়দের নীরব কান্না যেন কেউ শুনছেনা।

পারিশ্রমিকের দিক থেকে ৭ লাখ টাকা নিয়ে আশরাফুলের পরের অবস্থানে রয়েছেন মোহামেডানের রাসেল মাহমুদ জিমি। তাকে এখনো দেশসেরা ষ্ট্রাইকার বলা হয়ে থাকে। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে পেয়েছেন মোহামডানে যোগ দেওয়া সারওয়ার হোসেন ও মাইনুল ইসলাম কৌশিক। একই ক্লাবে থেকে যাওয়া ইমরান হোসেন পেয়েছেণ সাড়ে ৪ লাখ টাকা। মোহামেডানে যোগ দেওয়া বিকেএসপির কয়েকজন খেলোয়াড়কে গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ক্লাব সুত্রে জানা গেছে, স্থানীয় খেলোয়াড়দের পেছনে সাদা-কালোদের খরচ হয়েছে ৭০ লাখ টাকা।

সবচেয়ে শক্তিশালী দল গড়া আবাহনীর ৭ খেলোয়াড় পুস্কর ক্ষীসা মিমো, হাসান জুবায়ের নিলয়, নাঈম হোসেন, ফরহাদ আহমেদ শিটুল, রুম্মান সরকার, খোরশেদ আলম ও রেজাউল করিমরা ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা করে পারিশ্রমিক পেয়েছেন। ধানমন্ডির জায়ান্টরা ১৮ জন স্থানীয় খেলোয়াড়ের পেছনে তাদের ব্যয় হতে পারে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। দুই প্রধানের পর মেরিনার ইয়াংসও মোটামুটি বড় অঙ্ক খরচ করে চ্যাম্পিয়ন ফাইটে থাকার মতো দল গড়েছে। সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়ে জাতীয় দলের সাবেক ডিফেন্ডার মামুনুর রহমান ও ফজলে রাব্বিকে দলে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে প্রথম সারির বাকি খেলোয়াড়দের ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ প্রদাণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরির সুবাদে সার্ভিসেস খেলোয়াড়দের খেলাটিকে বাচিঁয়ে রেখেছেন। জীবন-জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তা না থাকায় তারা নিশ্চিন্তে খেলে যাচ্ছেন।

কিন্তু এর বাইরের খেলোয়াড়দের আয় বলতে এই লিগ থেকে যা পাওয়া যায় সেটাই। অনেক কষ্ট নিয়ে জাতীয় দলের এক ডিফেন্ডার বলেন, ‘আমাদের প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ এমনিতেই নিয়মিত হয় না। তার ওপরে ক্লাবগুলো টাকা না দিয়েই দল গড়তে চায়। সে কারণে মাঝে মাঝে মনে হয় খেলেই বোধহয় ভুল করেছি। এভাবে বেঁচে থাকাটাই যে কঠিন এক কাজ আমাদের জন্য। এতটা কষ্ট নিয়ে খেলোয়াড়দের পক্ষে বাল খেলাটা কতটা সম্ভব সেই ভাবনা এখন ভাবতে হবে। আর বিভিন্ন বাহিনীতে কতদিন হকি বেঁচে থাকবে সেই প্রশ্নও রাখছেন কেউ। খেলোয়াড় না বাচঁলে খেলাকে কোনভাবেই বাচিঁয়ে রাখা সম্ভব হবেনা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link