দীর্ঘদিন ধরে বার্সেলোনায় খেলা লিওনেল মেসির কারণেই স্প্যানিশ দলটিতে এসেছিলেন নেইমার। এরপর কয়েক মৌসুম শেষে যোগ দেন পিএসজিতে। ফরাসি দলটিতে মেসিকে নেওয়ার অনেক চেষ্টাই করেছেন। মাঝেমধ্যেই দুজনের দেখা হয়। যখন দলবদলের মৌসুম শুরু হয় তখনি হয় মেসির পিএসজিতে যাওয়ার কিংবা নেইমারের বার্সেলোনায় ফিরে আসার গুঞ্জন তৈরি হয়।
যদিও, এখন পর্যন্ত এসবের কিছুই বাস্থবায়িত হয়নি। তবে এখনো অটুট রয়েছে মেসি-নেইমার বন্ধুত্ব। আর্জেন্টাইন সুপারষ্টারের প্রতি নিজের ভাললাগার কথা প্রায়ই বলে থাকেন নেইমার। বলেছেন এবারো। যখন কোপা আমেরিকা কাপের ফাইনালে মাঠে নামার অপেক্ষায় বিশ্ব ফুটবলেল দুই দর্শক নন্দিত দল, তখনি আবারো প্রকাশ্যে আসে দ ‘জনের বন্ধুত্বের বিষয়টি। নেইমার তো মাঠে কোন বন্ধুত্ব থাকবে না বলে পরিস্কার করে দিয়েছেন।
অন্যদিকে মেসি মুখে কিছু না বললেও শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে কোন ছাড় নয় বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন। মাঠের লড়াই ছাপিয়ে এখন আলোচনায় দুজনের বন্ধুত্ব। বার্সা ছেড়ে যাওয়ার পরও একসাথে মিলিত হওয়ার অনেক ছবিই এসেছে পত্রিকায়। সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন লুইজ সুয়ারেজ।
মেসির সাথে উরুগুয়ের এই ষ্ট্রাইকারের মাঠে দেখা হলেও নেইমারের হয়নি। মেসি জয় দিয়েই বন্ধুর সাথে ম্যাচটিকে স্বরণীয় করে রেখেছেন। কিন্তু ফাইনাল বলে কথা, যতই বন্ধুত্বের কথা বলা হউক না কেন সেটি যে মাঠে কোন প্রভাব থাকবেনা সেটি পেশাদার ফুটবল বলেই সম্ভব মনে হচ্ছে। তাহলে কি ভেঙে যাচ্ছে দুজনের মধ্যে থাকা বন্ধুত্ব?
নেইমারের এই মেসির প্রতি আলাদা একটা টান বেশ পুরনো। নিজের দেখা সেরা ফুটবলার মেসি, এমন কথা প্রায়শই বলে থাকেন এই ব্রাজিলিয়ান প্লে-মেকার। যেমন করে সাবেক ব্রাজিলিয়ান দানি আলভেজও বলেছেন, মেসি সর্বকালের সেরা ফুটবলার আর নেইমার সময়ের সেরা ফুটবলার।
একদিকে লিওনেল মেসি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে এখনো দেখা পাননি আন্তর্জাতিক কোন শিরোপার। অন্যদিকে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ব্রাজিলের হয়ে শিরোপা ধরে রাখার লক্ষ্য নেইমারের। স্বাগতিক দেশের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের পরিসংখ্যান অনেকটাই নির্ভার রাখছে পিএসজি সুপারস্টারকে।
অন্যদিকে মেসি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ফাইনালে যে নিষ্প্রভ সেটি অনেকবারই প্রমাণিত হয়েছে। তবে এবারের কোপা আসরকে একটু ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আপনি যদি মেসির শত্রুও হন তাহলে চাইবেন শিরোপাটা যেন তার হাতেইওঠে। পুরো আসরে চারটি গোল করার পাশাপাশি পাচঁটি গোলে তার সহায়তা রয়েছে।
নেইমারও তার দলের প্রাণভোমরা হয়ে আছেন। সেমিফাইনালে তার বাড়ানো বলে গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু পাইনালে কেমন হবে দুজনের লড়াইটা। সেটি দেখার জন্য কোটি ফুটবল চোঁখ এখন অপেক্ষা করছে। সেখানে এই ম্যাচটিকে বন্ধুত্বের বাইরে একটি ম্যাচ হিসেবেই মূল্যায়ন কবতে চাইছেন অনেকে।
অনেকেই তাই ভুলে যেতে চান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকি। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নিচে না পৌঁছালেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইলো।’ বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় এই উদাহরণ বারবারই টেনে আনা হয়। বন্ধুত্ব, সে তো এক আত্মার সম্পর্ক।
অনেকেই আবার এর মহাত্ব বোঝাতে স্ত্রীর চেয়ে বন্ধুর মূল্য বেশি বলে নানা সময় বলে থাকেন। সে কারণেই বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির নাম বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের মাঝে যখন দায়িত্ব, কর্তব্য, অঙ্গীকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চলে আসে তখন সেটির বিশেষন হয়ে যায় শত্রু! লিওনেল মেসি-নেইমার জুনিয়র এখন সেই অবস্থাতেই রয়েছেন।
কোপায় ১৪ বছর আগে শেষবার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মুখোমুখি লড়াইয়ে সেলেসাওরা জয় পেয়েছিল ৩-০ গোলে। এরপর আর দক্ষিন আমেরিকার শ্রেষ্টত্বের আসরে দেখা মেলেনি দুই দলের। এবার ২৮ বছরের আন্তর্জাতিক শিরোপা খরা কাটানোর মিশনে নেমেছে মেসির আলবি সেলেস্তারা।
দলকে ফাইনালে নিয়ে যেতে মেসি-নেইমার দুজনই রেখেছেন বড় অবদান। নিজে যেমন গোল করেছেন আবার সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেনও। সব মিলিয়ে দুজনের সরব উপস্থিতি পাল্টে দিয়েছে গোটা দলের চিত্র। এবার ফাইনাল মঞ্চে দুই বন্ধুর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের পালা।
২০১৩ সালে সান্তোস ছেড়ে নেইমার বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই বন্ধুত্বে শুরু। ন্যু ক্যাম্পে মেসি নিজেকে স্থায়ী করেছেন। নেইমারকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচ মৌসুম খেলেছেন বার্সায়। এই সময়ে দুজন জুটি বেঁধে আটটি শিরোপা জিতিয়েছেন।
দুটি লা লিগা, তিনটি কোপা দেল রে, একটি করে চ্যাম্পিয়নস লিগ, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন মেসি-নেইমার জুটি। যার মধ্যে আবার ২০১৪-১৫ মৌসুমে জিতেছেন মহাদেশীয় ‘ট্রেবল’ লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কোপা দেল রে।
বার্সায় পরের ২০১৫-১৬ মৌসুমে ঘরোয়া ‘ডাবল’ জয় করেছেন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গাঢ় হয়েছে দুজনের বুন্ধত্ব। এরপর নেইমার রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে যোগ দিলেও বন্ধুর জন্য ভালোবাসা ও সম্মান একটুও কমেনি মেসির। ঠিক নেইমারও মেসির জন্য বন্ধুত্বের পতাকা উড়িয়েছেন অনেকবার। এবার কি তাহলে সেই সম্পর্কটা ভেঙে যেতে বসেছে?
মাঠে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলে যার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তবে দলের প্রয়োজনে যদি দুই বন্ধু মুখোমুখি হয়ে যায় তাহলে ছেদ পড়তে পারে বন্ধুত্বে। তবে ফুটবল ভালবাসা মানুষগুলো কোনভাবেই চাইবেন না মেসি-নেইমার বন্ধুত্ব ভেঙে যাক।