হরভজন সিং আর অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের সম্পর্কটা একসময়ে ছিল সাপে নেউলে । ২০০৭-০৮ সালের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে ঘটে সেই ‘মাংকিগেট’ কেলেঙ্কারি। অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা হয়েই তা আজও রয়ে গেছে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু সেই তিক্ততা একসময় পরিণত হয় এক হৃদয়স্পর্শী বন্ধুত্বে। সময়ের সঙ্গে, তাদের গল্প হয়ে ওঠে ভুল বোঝাবুঝি আর তিক্ততাকে পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার এক অনন্য উদাহরণ।
সিডনির সেই নতুন বছরের টেস্ট। ম্যাচ যতটা উত্তেজনায় ভরা ছিল, ততটাই কলঙ্কিত হয়েছিল শেষ দিনে। ম্যাচের উত্তপ্ত মুহূর্তে রিকি পন্টিং অভিযোগ করেন, হরভজন নাকি সাইমন্ডসকে উদ্দেশ্য করে বর্ণবিদ্বেষমূলক ‘মাংকি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অভিযোগের পর থেকেই শুরু হয় দুই দলের মধ্যে এক তিক্ত লড়াই। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা তাদের বক্তব্যে অনড় ছিলেন। বিশেষত মাইকেল ক্লার্ক দাবি করেন তিনি স্পষ্ট শুনেছেন এই মন্তব্য। ম্যাচ রেফারি মাইক প্রোক্টর, হরভজনকে তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করেন।
কিন্তু ভারতীয় শিবির সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নেয়। শচীন টেন্ডুলকার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, হরভজনকে উসকানোর চেষ্টা করছিলেন। তখন হরভজন শুধু রাগের মাথায় বলেন ‘তেরি মা কি’। এটি সাধারনত ভারতের উত্তরাঞ্চলের মানুষ রেগে গেলে গালি হিসেবে ব্যবহার করে। এর মধ্যে কোনো বর্ণবিদ্বেষ ছিল না।’
অনিল কুম্বলের নেতৃত্বে দল ঘোষণা করে, ‘হরভজনের শাস্তি না কমালে আমরা সফর বর্জন করব।’ চাপের মুখে আইসিসি শাস্তি কমিয়ে ম্যাচ ফি-এর ৫০ শতাংশ জরিমানা করে। ভারতীয় দল সিডনির সেই তিক্ততা ভুলে পার্থে চমকপ্রদ জয় তুলে নেয়। কিন্তু সেই বিতর্ক ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে গেঁথে যায়।
এরপরের গল্পটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১৩ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে একসঙ্গে খেলার সময় হরভজন আর সাইমন্ডসের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে। ভুল বোঝাবোঝির অবসান ঘটে চণ্ডীগড়ে। এক বন্ধুর পার্টিতে সাইমন্ডস তখন একটি রামের বোতল নিয়ে হরভজনের কাছে আসেন। দীর্ঘ সময় ধরে তারা কথা বলেন। সেই কথোপকথনের শেষে দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন।
হরভজন বলেন, ‘আমরা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিলাম, আর শেষে এক দীর্ঘ আলিঙ্গনে সব তিক্ততা মুছে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তের ছবিটা আমাদের চ্যাট গ্রুপে খুব আলোচিত হয়ে উঠেছিল।’
তারপর তারা যেন পুরোনো ঘৃনা ভুলে এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলেন। স্মতিচারণ করে হরভজন বলেন, ‘আমরা প্রায়ই একসঙ্গে সময় কাটাতাম। এটি আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময় ছিল।’ কিন্তু এই বন্ধুত্বকে চিরতরে থামিয়ে দেয় সাইমন্ডসের অকাল মৃত্যু।
স্টার স্পোর্টসের এক টকশোতে কথা বলতে গিয়ে হরভজন বলেন, ‘এখন আমার মনে হয়, ইশ! সেদিন আমাদের কারও মধ্য যদি ঝামেলা না হত। তার মৃত্যুর খবর শুনে আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। প্রথমে শুনে হতবাক হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম মিথ্যা গুঞ্জন। গত সপ্তাহে ব্রিসবেনে নামার পরেই মনে হয়েছে যদি সে আজ বেঁচে থাকত, আমি ব্রিসবেনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতাম। আমরা হয়তো একসঙ্গে বাইরে যেতাম। আমাদের বন্ধুত্ব এমনই ছিল।’
এই গল্প শুধু ক্রিকেট মাঠের তিক্ত লড়াই থেকে বন্ধুত্বের উত্থান নয়। এটি ক্ষমার সৌন্দর্য আর অতীতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার এক অনন্য বার্তা। হরভজন আর সাইমন্ডস আমাদের শেখায়, জীবনে দ্বিতীয় সুযোগকে গ্রহণ করার মতো সাহস রাখতে হয়।