আম্পায়ার সৈকত, মেইড ইন বাংলাদেশ

এই দৃশ্য দেখে হয়তো ভবিষ্যতের কোনো তরুণ ভাববে—বাংলাদেশের আম্পায়ার? হ্যাঁ, তারা বিশ্বসেরা হতে পারে।

ব্রিসবেনে তখন সকাল ছিল না, তারপরও আলোটা একটু বেশি ঝলমল করে উঠেছিল—অন্তত বাংলাদেশের ক্রিকেট-মানচিত্রে। অনফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে আদ্রিয়ান হোল্ডস্টকের সাথে যিনি নামলেন তাঁকে খুব সহজেই চেনা যাচ্ছিল।

চোখে গভীর মনোযোগ, ঠোঁটের কোণে লাজুক দৃঢ়তা, আর মনোনিবেশের এক অপরাজেয় যন্ত্র তিনি। নাম— শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত, মেড ইন বাংলাদেশ। যাকে এখন পুরোদমে বলা যায়— বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।

বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন নিজের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করে বড় হতে চেয়েছে, তখন কোথাও এক কোণে বড় অযত্নে নি:শব্দে বড় হচ্ছিল সৈকতের নামটি। তাকে ঘিরে প্রচার কম, হাততালি কম, অথচ দায়িত্বের কঠিনতম জায়গায় দাঁড়িয়ে বছরের পর বছর ধরে তিনি তৈরি করে গেছেন আস্থার এক দৃঢ় সেতু।

বছর দুয়েক হল এলিট আইসিসি আম্পায়ার। অ্যাশেজের মতো ক্রিকেটের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী লড়াইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে অন-ফিল্ড দায়িত্ব পালন করা প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার বনে গেলেন তিনি। এই অর্জন দেশের আম্পায়ারিংয়ের পালে নতুন করে হাওয়া দিল, গড়ল নতুন ইতিহাস।

ঢাকার কোনো এক সকালে, ১৯৭৬ সালের অক্টোবরের আলোয় জন্ম নেওয়া ছেলেটির হাতে প্রথমে ছিল ব্যাট-বল। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান, স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স বোলার—ঢাকা মেট্রোপলিসের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। কিন্তু কখনও এতটা পারফরম করতে পারেননি, যেটা ক্রিকেটার হিসেবে তাঁকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাবে।

কেউ ব্যাট-বল ফেলে কলম তুলে নেয়, কেউ হাতে নেয় কমেন্ট্রি বক্সের মাইক্রোফোন। সৈকতও সেভাবেই ক্রমে আম্পায়ারিংয়ের দিকে ঝুঁকলেন। মাঠের কেন্দ্রে থাকার একাকিত্বই তাঁকে টানল, আর কালক্রমে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য, সম্ভবত এখন ক্রিকেট বিশ্বেরও অন্যতম সেরা।

২০০৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক প্যানেলে কাজ শুরু করা সৈকত ছিলেন ধীরে ধীরে উত্থানের নীরব দৃষ্টান্ত। প্রতিটি সিদ্ধান্তের মধ্যে শুদ্ধতা রেখে তিনি নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন। স্থীরতা, একাগ্রতা আর সাহস তাঁকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসছেন। সৈকত তাই কেবল একজন আম্পায়ার নন—তিনি বাংলাদেশের পক্ষে বাজতে থাকা এক নীরব সিম্ফনি, ইতিহাসের পাতায় খোদাই হয়ে থাকা এক উজ্জ্বল আলোকরেখা।

এর সবশেষ এবং সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় এল ২০২৪ সালের এপ্রিলে, যখন ঘোষণা এলো—শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত আইসিসি এলিট প্যানেলে জায়গা পেয়েছেন। বিশ্বের সেরা আম্পায়ারদের তালিকা, সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন, যেখানে প্রবেশ করা মানে পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। টেস্ট খেলুড়ে দেশে এটি সাধারণ ঘটনা; কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটা ছিল যুগান্তকারী ঘটনা।

বাংলাদেশের বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে সৈকতের এই উন্নতি কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, এটি পুরো কাঠামোর ওপর আলো ফেলে যাওয়া এক দৃষ্টান্ত। অ্যাশেজে দায়িত্ব পাওয়া—বাংলাদেশের জন্য আরও এক স্বপ্নপূরণ। পার্থ টেস্টে তিনি টিভি আম্পায়ার ছিলেন। সেখানেও তিনি জেমি স্মিথের আউটে দেখিয়েছেন ভূয়সী সাহস, আইসিসির নিয়ম আর নিজের বোধশক্তির ওপর ভরসা রেখেছেন। দর্শকরা গর্জে উঠল, কিন্তু আইসিসির নিয়ম বলল—সৈকত ঠিকই করেছেন।

বাংলাদেশে আম্পায়ারিং দীর্ঘদিন ছিল অবহেলার জায়গা। কিন্তু সৈকত ও মুকুলদের পরিশ্রমে চিত্রটা পাল্টে যাচ্ছে। তরুণেরা এখন আম্পায়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বিসিবি তাকে এ+ গ্রেড দিয়েছে—স্বীকৃতির ছাপটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে হয়তো ভবিষ্যতের কোনো তরুণ ভাববে—বাংলাদেশের আম্পায়ার? হ্যাঁ, তারা বিশ্বসেরা হতে পারে।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link