২০০৭ সালের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ফাইনাল ম্যাচের ফাইনাল ওভার। বল হাতে অনামী যোগিন্দর শর্মা। সেই দেখেই ভুরু কুঁচকে গেল তাবড় ক্রিকেট বোদ্ধাদের। করে কি এ ক্যাপ্টেন? সদ্য একই বছরে ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভরাডুবি হয়েছে ভারতের।
তথাকথিত নতুন দল নিয়ে নতুন অধিনায়ক খেলতে এসেছে এই নতুন ফরম্যাটের বিশ্বকাপ। ১৩ রান দরকার শেষ ৬ বলে। সামনে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মিসবাহ উল হক। প্রথম বল ওয়াইড, দ্বিতীয় বলে কোনো রান হল না, তৃতীয় বলে ৬। চার বলে বাকি ৬ রান। অধিনায়ক দৌড়ে এসে অভয় দিয়ে গেলেন বোলারকে।
পরের বলে স্কুপ শট খেলতে গেলেন মিসবাহ। বল জমা পড়ল শ্রীশান্তের হাতে। উদ্বেল হল জনতা। সেই আনন্দের স্ফুলিঙ্গের ছড়িয়ে গেল ড্রেসিং রুম থেকে গোটা দেশে। এক অদৃশ্য শাপমোচনের পরিতৃপ্তিতে ভেসে গেল ১০০ কোটি ভারতীয়। নেপথ্যে এক ছোট্ট শহরের ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা অকুতোভয় ছেলেটা।
কিন্তু না, তারপরেও সে না কি ডিফেন্সিভ ক্যাপ্টেন!
২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল। শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দ্র শেবাগ, বিরাট কোহলিকে হারিয়ে ভারত তখন ধুঁকছে। মাঠে বলের আগুন ঝরাচ্ছেন লাসিথ মালিঙ্গা, বা মুত্তিয়া মুরালিধরণরা। কোহলি আউট হতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে অন ফর্ম যুবরাজের জায়গায় ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন তিনি। সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। কিন্তু তিনি নিজে বোধহয় অন্যকিছু ভেবেছিলেন।
সেই ম্যাচে প্রথমে গম্ভীর এবং পরে যুবরাজ কে সাথে নিয়ে দল কে পৌঁছে দিলেন জয়ের দোরগোড়ায়। ২৮ বছর পর আবার দেশ মেতে উঠল বিশ্বজয়ের আনন্দে। ফাইনালে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ- সেই ছোট্ট শহরের ছেলেটি, না ঝাঁকড়া চুল টা কেটে ফেলেছে ততদিনে। কিন্তু না, তারপরেও সে না কি টিমের থেকে নিজের কথা আগে ভাবে!
২০১৪ সালের মেলবোর্ন, টেস্ট শেষে আচমকাই ড্রেসিং রুমে টিম হার্ডল করলেন। সেখানেই নিজের সতীর্থদের জানিয়ে দিলেন, আর নয় সাদা জার্সি। বিশ্বাস করতে পারেনি প্রথমে কেউ। সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর ডেপুটি কোহলি প্রথমে অবসর না নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু তিনি তো অবিচল।
শুনলেন না কারো কথা। জানিয়ে দিলেন প্রেস কনফারেন্সে। টেস্ট অবসরের প্রাক্কালে তার টেস্ট ম্যাচ সংখ্যা টা জানেন?? মাত্র ৯০। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১০ টি ম্যাচ দূরে। যে কোনো ক্রিকেটারের কাছে ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলা স্বপ্নের। তিনি বোধহয় অন্য ধাতু দিয়ে গড়া।
কিন্তু না, তারপরেও সে না কি নিজের কোটার প্লেয়ার দিয়ে দল চালান!
এরকম অজস্র ঘটনা আছে এনার জীবনে। যেগুলি সহজ বোধবুদ্ধি কিংবা যুক্তির মাপকাঠিতে বিচার করা সম্ভব হবে না। সে তার অগ্রজের শেষ টেস্টের অন্তিম লগ্নে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড ফিরিয়ে দেওয়াই হোক অথবা নিজের অধিনায়কত্বের ১৯৯তম ওয়ানডে ম্যাচের পর আর্মব্যান্ড অনুজ কে এগিয়ে দেওয়া।
সবেতেই তিনি বাঁধা ছক হীন। কোনো স্ক্রিপ্ট তার জীবনের সাথে মেলে না। হয়তো তিনি সব ক্রিকেট প্রেমী কিংবা ক্রীড়া সাংবাদিক দের হাসিমুখে বাইট দিয়ে খুশি করেন নি কিন্তু দেশ কে উপহার দিয়েছেন ২টি বিশ্বকাপ, ১টি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। দেশকে বসিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটের শিখরে।
শচীনের মত ক্লাস নেই, সৌরভের মত আগ্রাসন নেই, নেই সুনীলের মতো ধৈর্য্য। কিন্তু আছে এক দৃঢ় মানসিকতা, এক মধ্যবিত্তের অদম্য জেদ আর আছে ইস্পাত কঠিন হিমশীতল মস্তিষ্ক।
না বলা অনেক কথা হয়তো বলে গিয়েছেন এভাবেই। হয়তো এভাবেই কোনো একদিনের সকালে বিষাদের সুরে বেজে উঠবে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। হয়তো আচমকাই জানিয়ে দেবেন , অনেক হল আর নয়। ব্যাট প্যাড চলে যাবে পেনশনের খাতায়। ডিআরএস ও হয়তো ‘ধোনি রিভিউ সিস্টেম’ নামটা কে সযত্নে মুড়িয়ে রাখবে নিজের চিলেকোঠায়। হয়তো ক্রিকেট বিশ্ব ‘Mahendra Singh Dhoni’ নামটার পাশে Instagram এর মতো ‘Remembering’ করে রাখবে।
তখন হয়তো ব্যাকগ্রাউন্ডে নিচের কথাগুলি তিনি আপন মনে গেয়ে উঠবেন।
ফিরিবার পথ নাহি,
দূর হতে দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়,
হে বন্ধু, বিদায়!