দুর্ভাগা এক লাকি চার্ম

১৬ জানুয়ারি, ২০০৯। শীতের দুপুরে রোদ্রজ্জ্বল আবহাওয়ায় ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে মুখোমুখি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশের দেওয়া ১৫৩ রানের টার্গেটে ব্যাটিংয়ে নামে লঙ্কানরা। শক্তিশালী লঙ্কানদের জন্য বেশ সহজ এক লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো লঙ্কানদের শক্তিশালী টপ অর্ডার দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়ে। চোখের পলকে ৬ রানের মাথায় লঙ্কানদের ৫ উইকেট নেই! হোম অব ক্রিকেট খ্যাত – মিরপুরে সমর্থকদের জন্য বাঁধভাঙ্গা খুশির জোয়ার। এ যেন অবিশ্বাস্য আর জাদুকরী এক কান্ড।

সেদিন লঙ্কানদের এই ধসের পেছনের মূল নায়ক ছিলেন পেসার নাজমুল হোসেন। দুর্দান্ত এক স্পেলে ধসিয়ে দেন লঙ্কানদের টপ অর্ডার। অবশ্য ম্যাচের আগে তিনি একাদশে থাকবেন কিনা সে নিয়ে ছিল সংশয়!এমনকি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান কোচ জেমি সিডন্স ম্যাচের ২০ মিনিট আগে তাঁকে বলেছিলেন, ‘ যদি খারাপ করো আর কখনোই তুমি সুযোগ পাবে না। ‘ কোচের এমন কথায় বিস্মিত হয়েছিলেন খোদ নাজমুলও। অবশ্য এমন ঘটনার সম্মুখীন প্রথমবার হননি নাজমুল।

এর কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজে প্রথম ওয়ানডেতে ৫৫ রানে ১ উইকেট নেন নাজমুল। পরের ওয়ানডেতে অধিনায়ক নাজমুলকে একাদশে রাখার কথা বললে সিডন্স অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই বলেছিলেন, ‘ওকে তো ব্যাটসম্যানরা হেঁটে হেঁটে পিটাবে।’

সেদিনের ফাইনালে প্রথম পাঁচ উইকেটের তিনটিই শিকার করেন নাজমুল। সেদিন মুরালির অবিশ্বাস্য এক ইনিংসে ম্যাচটা বাংলাদেশ হারলেও নাজমুল হোসেনের সেই স্পেল আজো ক্রিকেট প্রেমীতের স্মৃতি আঁকড়ে আছে। ১০ ওভারে মাত্র ৩০ রানে ম্যাচে তিন উইকেট শিকার করেন নাজমুল।

জেমি সিডন্সের প্রিয় তো দূর একপ্রকার চোখের বিষ ছিলেন নাজমুল। খেলোয়াড়ের সাথে কোচের এমন সম্পর্ক নিশ্চই মেনে নেওয়ার মত না? ঠিক কি কারণে তাঁর প্রতি কোচের বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না – সেটিও কখনো খুঁজে পাননি নাজমুল।

‘ বলে গতি নেই, মার খাবে, ওকে দলে প্রয়োজন নেই ‘ – এই ব্যাপার গুলোর জন্যই নাকি সিডন্সের আমলে চরম উপেক্ষিত ছিলেন নাজমুল। দলে প্রয়োজন নেই ঠিক কিন্তু কারো ইনজুরি কিংবা দলে অতিরিক্ত পেসারের প্রয়োজন পড়লেই – নাজমুলের দ্বারস্থ হতো টিম ম্যানেজমেন্ট।

২০০৭ সালে কোচ হিসেবে ডেভ হোয়াটমরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রধান কোচের দায়িত্ব পান অস্ট্রেলিয়ান জেমি সিডন্স। ঠিক ওই সময় থেকেই দলে আর থিতু হতে পারেননি নাজমুল। হোয়াটমোরের আমলে অনেকটা নিয়মিত সুযোগ পেলেও সিডন্সের কাছে তিনি কোনো পাত্তাই পাননি নেই পেসার। একে তো উপেক্ষিত তার উপর ক্যারিয়ারে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ইনজুরি।

আক্ষেপ, হতাশা, কষ্ট সবটাই বুকে চেপে রেখে বার বার ফেরার আশায় প্রহর গুনেছেন তিনি। সেসময়ের বেশ প্রতিভাবান একজন পেসার ছিলেন নাজমুল। তাপশ বৈশ্য, শাহাদাত হোসেন, মাশরাফি মুর্তজা, শফিউল ইসলাম, রুবেল হোসেনদের ভীরে সবার আড়ালেই থেকে যান নাজমুল। প্রয়োজন শেষেই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বার বার।

অবশ্য এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তরও কখনো পাননি তিনি। গতি কম, মার খাবেন, বেশি রান খরচা হবে বিধায় একাদশে থেকেও বোলিংয়ের সুযোগ পাননি – এমনটাও ঘটেছে! কখনো তৃতীয় পেসার হিসেবে আবার কখনো কারো ইনজুরিতে ব্যাকআপ হিসেবেই দলে আসা যাওয়ার মাঝে ছিলেন নাজমুল।

১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৪। আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষিক্ত হন ১৮ বছর বয়সী তরুণ সম্ভাবনাময় এক তারকা পেসার – নাজমুল হোসেন। অভিষেক ম্যাচে উইকেটশূন্য থাকলেও ৬ ওভারে মোটে ১৭ রান দেন তিনি। একই বছর ডিসেম্বরে ভার‍তের বিপক্ষে চট্রগ্রামে টেস্ট অভিষেক। এরপর ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও ইনজুরির কারণে সাদা পোশাকে আর ফিরতে পারেননি তিনি।

২০০৫ সালে কার্ডিফে অজি বধের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে অজি ওপেনার ম্যাথু হেইডেনকে বোল্ড করে ভয়ংকর হতে যাওয়া জুটি ভেঙ্গে দেন। সেসময় কোচ ডেভ হোয়াটমোরের অধীনে বেশ ভালো সুযোগই পেয়েছিলেন তিনি। এরপর ইনজুরিতে দু’বছরের জন্য ছিটকে গেলেন। যখন ফিরলেন তখন বাংলাদেশের প্রধান কোচ জেমি সিডন্স।

এরপর দলে আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। কখনো টিম কম্বিনেশন তো কখনো ইনজুরি। কখনো আবার কারণ ছাড়াই তিনি দলের বাইরে। একটা সময় পর চুক্তির মেয়াদ শেষে জেমি সিডন্স বিদায় নিলেন। তবু একাদশে আর নিয়মিত হতে পারেননি তিনি। দলে থিতু হতে না পারার কারণটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন নাজমুল।

২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক। এর দু’বছর পর ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রায় সাত বছর পর টেস্টে ফিরেন তিনি। সেটি ছিলো সাদা পোশাকে তাঁর খেলা শেষ ম্যাচ। এরপর ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপ আসর। ভাগ্যক্রমে স্কোয়াডে ঠাঁই পেলেন। স্কোয়াডে থাকার পরেও এক ম্যাচেও একাদশে সুযোগ পাননি তিনি।

পরের বছর ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে মাত্র ১ রানের হারের আক্ষেপে পুড়েছিল পুরো বাংলাদেশ। আগের ম্যাচেই লঙ্কানদের বিপক্ষে ৮ ওভারে ৩২ রানে তিন উইকেট শিকার করেন নাজমুল। এরপর ফাইনালে ৮ ওভারে ৩৬ রানে ১ মেইডেনসহ নেন ১ উইকেট। ব্যাস, ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের শেষ ম্যাচটা খেলে ফেললেন।

ওই বছরই নেদারল্যান্ডসের হ্যাগে দু’টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেন তিনি। এরপর আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি নাজমুল। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের দলে ডাক পেলেও অনুশীলনের সময় চোট পেয়ে ছিটকে যান তিনি। জাতীয় দলের দরজাও চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় নাজমুলের জন্য।

টেস্টে ফেরারও আর সুযোগ নেই, টি-টোয়েন্টতেও মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে। একমাত্র ওয়ানডেতে বেশ সফল এই পেসার ইনজুরির আর অবহেলার শিকার হয়ে আর ফিরতে পারেননি জাতীয় দলে। জাতীয় দলের মতো ঘরোয়া ক্রিকেটেও হয়েছেন বঞ্চনার শিকার। সেসময় জাতীয় লিগে তাঁর দলের পক্ষ থেকে ৪০ সদস্যর স্কোয়াড ঘোষণা করলেও নিজের নাম খুঁজে পাননি নাজমুল।

মাত্র ২৮ বছর বয়সেই ক্ষোভে ক্রিকেট ছেড়ে পাড়ি জমান বিদেশে। তবে বেশিদিন থাকতে পারেননি প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে। তিন বছর বাদে আবার ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। এরপরই মাত্র ৩১ বছর বয়সে ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানান তিনি।

২ টেস্টে ৫ উইকেট, ৩৮ ওয়ানডেতে ৫ ইকোনমিতে ৪৪ আর ৪ টি-টোয়েন্টিতে ১ উইকেট নেওয়া নাজমুলের ক্যারিয়ারটা ক্যালেন্ডারের পাতায় ১১ বছরের। এই ১১ বছরে মোটে ৪৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন তিনি। ইনজুরিতে ছিটকে গেলেও বার বার ফিরে এসেছেন ‘ফিনিক্স’ পাখির মতো। কিন্তু বার বারই তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। বাংলাদেশের জয় পাওয়াটা যে সময় ছিলো সোনার হরিণের মতো – সে সময়ে ক্রিকেট সমর্থকদের প্রাপ্তির একটা অংশ ছিলো নাজমুল হোসেনের বোলিং। যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন কিপটে বোলিংয়ে প্রতিপক্ষের রান আটকে রাখতে নিজের সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়েছেন।

ড্রেসিং রুমে তাঁকে ডাকা হতো ‘লাকি চার্ম’। কিন্তু তাঁর ভাগ্য কখনোই সহায় ছিল না। ইনজুরিতে ছিঁটকে গিয়ে ফিরে এসে সেরাদের একজন হয়েছেন – এমন কত নাম আছে। কিন্তু ফিরতে পারেননি নাজমুল! গতি কম হলেও  ম্যুভমেন্টের কারণে ব্যাটসম্যানরা প্রায়-ই বিপাকে পড়তো তাঁর বল খেলতে।

একসমইয়ের অপার সম্ভাবনাময়ী এই পেসারের দীর্ঘ ১১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা শুধু আক্ষেপ আর কষ্টে জর্জরিত। তবু, হয়তো অর্জিত গুটিকয়েক সুখস্মৃতিগুলো নিয়ে আক্ষেপটা ভুলে থাকতে চাইবেন নাজমুল। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তিনি খসে পড়া তারকা হিসেবে থাকবেন চিরকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link