অসময়ে জন্ম নেয়া অজি দুর্ভাগা

নিজের প্রথম ম্যাচেই ব্যাট হাতে চমক দেখান তিনি, এগারো নম্বরে ব্যাট করতে নেমে খেলেন ৯৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। সেদিন ফিলিপ হিউজের সাথে দশম উইকেটে গড়েছিলেন রেকর্ড ১৬৩ রানের জুটি। অভিষেকে এগারো নম্বরে নেমে হাফসেঞ্চুরি কিংবা সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ড তাঁর দখলেই।

অস্ট্রেলিয়া দলে নাথান লায়নের মতো নিয়মিত মুখ তিনি নন। লায়ন কিংবা জাম্পাদের সাথে আরেকজন স্পিনারের প্রয়োজন হলেই কেবল তাঁর দেখা মেলে হলুদ জার্সিতে। অথচ তিনি তাঁদের চাইতে কোনো অংশে কম নন, বরং বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ের হাতটাও যথেষ্ট ভালো তাঁর। জাতীয় দলে যখনই সুযোগ এসেছে নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন, আত্ম-নিবেদনে কখনো ঘাটতি রাখেননি। তিনি অ্যাশটন অ্যাগার, অসময়ে জন্ম নেয়া এক অজি অভাগা। 

সোনিয়া হেওয়াসিয়া এবং জন অ্যাগার দম্পতি থাকেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। শ্রীলংকান সোনিয়া সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে অস্ট্রেলিয়া এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। সেখানেই পরিচয় জনের সাথে, মন দেয়া নেয়া করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। প্রণয় পরিণয়ে গড়াতেও খুব বেশি অপেক্ষার প্রহর পার করতে হয়নি, কয়েক বছর পরই সেরে ফেলেন শুভকাজটা। এই দম্পতির ঘর আলো করে পৃথিবীতে আগমন ছেলে অ্যাশটন অ্যাগারের। কখনো মেলবোর্নের রাস্তায়, আবার কখনো বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেলতে খেলতেই ব্যাট-বলের প্রেমে পড়ে ছোট্ট অ্যাগার। কৈশোর পেরোনোর আগেই সুযোগ পেয়ে যান বয়সভিত্তিক রাজ্য দলে। 

ভিক্টোরিয়ার হয়ে বয়সভিত্তিক লিগগুলোতে আলো ছড়াতে থাকেন নিয়মিতই। জাতীয় লিগে ১১ ম্যাচ খেলে ১৬ উইকেট নিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে ভালো খেলে ডাক পান ২০১২ সালে ছোটদের বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত ১৫ সদস্যের দলে। যদিও টুর্নামেন্টে সেবার কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তিনি। 

অস্ট্রেলিয়া তো বটেই তর্কসাপেক্ষে  ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা স্পিনার শেন ওয়ার্ন। তাঁর আর্বিভাবের পর থেকেই সব কিশোরই চায় বড় হয়ে লেগ স্পিনের মায়ায় ব্যাটসম্যানকে কাবু করতে। রাজ্য দলগুলোর নির্বাচকদেরও তাই বদ্ধমূল ধারণা, সাধারণ মানের লেগ স্পিনারদেরও তাঁরা ভেবে নেন ওয়ার্নের উত্তরসূরী হিসেবে। ফলে খেলার সুযোগ পেলে না বাঁহাতি কিংবা অফস্পিনারদের। এই বদ্ধজালে ফেসে যান অ্যাগারও, ছোটদের বিশ্বকাপ খেলে আসার পর তাঁর সাথে চুক্তি করতে রাজি হচ্ছিল না কোনো রাজ্যদলই। অবশেষে শেষ মূহুর্তে তাঁকে দলে ভেড়ায় ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া। হাসি ফেরে অ্যাগারের মুখে। স্বীকৃতির বালাই নেই, তিনি যে কেবল খেলতে চান। বাইশ গজে বল হাতে ছড়ি ঘুরাতে  কিংবা ব্যাট হাতে রান করাতেই যে তিনি খুঁজে পান প্রশান্তি। 

ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার আস্থার প্রতিদান দারুণভাবেই দেন অ্যাগার। নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই দলের বিপদের মুখে খেলেন ৫৩ রানের কার্যকরী ইনিংস। দশম উইকেটে মাইকেল হোগানের সাথে তাঁর গড়া ৯৪ রানের জুটির সুবাদেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাঁর দল। সে মৌসুমে একবার ইনিংসে পাঁচ উইকেটসহ নেন ১৯ উইকেট। এছাড়া ব্যাট হাতে ৩২.৩৯ গড়ে সংগ্রহ করেন ২২৯ রান। 

ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফরমেন্সের সুবাদে জাতীয় দলের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায় অ্যাগারের জন্য। ২০১৩ অ্যাশেজে নাথান লায়নের পাশাপাশি দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে দলে ডাক পান তিনি। কিন্তু ট্রেন্টব্রিজে ম্যাচের আগমূহুর্তে ইনজুরির কারণে লায়ন ছিটকে গেলে অপ্রত্যাশিত অভিষেক ঘটে অ্যাগারের। নিজের প্রথম ম্যাচেই ব্যাট হাতে চমক দেখান তিনি, এগারো নম্বরে ব্যাট করতে নেমে খেলেন ৯৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। সেদিন ফিলিপ হিউজের সাথে দশম উইকেটে গড়েছিলেন রেকর্ড ১৬৩ রানের জুটি।

অভিষেকে এগারো নম্বরে নেমে হাফসেঞ্চুরি কিংবা সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ড তাঁর দখলেই। কিন্তু বল হাতে তেমন আলো ছড়াতে পারেননি। ফলে দুই টেস্ট পরেই লায়ন ইনজুরি থেকে সেরে উঠলে একাদশে জায়গা হারান তিনি। চার বছর বাদে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের তৃতীয় টেস্টে প্রথমবারের মতো পাঁচ উইকেট পান তিনি। মূলত নাথান লায়নের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আর স্টিভেন ও’কিফি-মিচেল সোয়েপসনদের আবির্ভাবে প্রায় এক যুগের ক্যারিয়ারে খেলেছেন কেবল চারটি টেস্ট। 

টেস্টে অভিষেকের প্রায় তিন বছর পর সাদা বলের ক্রিকেটে অভিষেক অ্যাগারের। সেখানেও তাঁর রেকর্ড মোটামুটি মন্দ নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি মাত্র দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে তুলে নেন হ্যাটট্রিক। সেদিন চার ওভারে পঁচিশ রান খরচায় তিনি সাজঘরে ফেরান পাঁচ প্রোটিয়া ব্যাটারকে। তবে নিজের এই পারফরম্যান্সকে তিনি ছাড়িয়ে যান গত বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। তাঁর নেয়া ৩০ রানে ছয় উইকেটের বোলিং ফিগার অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসেরই সেরা বোলিং ফিগার। অথচ দলে খেলার সুযোগটা তিনি পান না নিয়মিত। কেবল লায়ন-জাম্পাদের মাঝে কেউ কোনো কারণে খেলতে না পারলেই সুযোগ মেলে তাঁর। 

অ্যাগারের মতো ক্রিকেটাররা একারণেই তাই অনুকরণীয় আদর্শ। বিশ্বজুড়ে তাঁদের লক্ষ-কোটি ফ্যান থাকে না, বাদ পড়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনও গড়ে উঠে না। তবু তাঁরা হাল ছাড়েন না, নীরবে-নিভৃতে নিজের চেষ্টা চালিয়ে যান। লড়ে যান নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...