বিজয় ভরদ্বাজ ও অসংখ্য যদি-কিন্তু

বলা হয়, ক্রিকেটের আবেগ খুবই সংক্রামক। উপমহাদেশে রোজ কত কিশোরই স্বপ্ন দেখেন বড় ক্রিকেটা হওয়ার। কিন্তু, ক’জনার স্বপ্নই বা পূরণ হয়। এদের মধ্যে কারো কারো স্বপ্ন থাকলেও সামর্থ্য থাকে না, কারো আবার সামর্থ্য থাকলেও ভাগ্য সহায় হয় না। আজ তেমনই এক দুর্ভাগা ক্রিকেটারের গল্প বলবো।

তিনি হলেন বিজয় ভরদ্বাজ। পুরো নামটা বেশ ভারি – রাঘভেন্দ্রারাও বিজয় ভরদ্বাজ। তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সার সংক্ষেপ হল তিন টেস্ট আর ১০ ওয়ানডে। তাঁর ক্যারিয়ারটা চাইলে অস্কার ওয়াইল্ডের কিংবদন্তিতুল্য বক্তব্য দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায় – ‘সাফল্য হল বিজ্ঞান, যদি তুমি সকল শর্তপূরণ করতে পারো, আর ফলাফল তোমার পক্ষে আসে।’

ভারতীয় ক্রিকেটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্য যারা রাখেন, তাঁদের এই চশমাধারী ভদ্রলোকের কথা মনে থাকতে পারে। তিনি তার ঘরোয়া ক্রিকেটে যাওয়া বিস্তর সাফল্যের ধারাবাহিকতা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাখতে পারেননি।

 

ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি ওপরের দিকে ব্যাট করতে পারতেন, অফ স্পিন বোলিং করতেন। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে ৮১.২৭ গড়ে চারটি সেঞ্চুরি-সহ ১,৪৬৩ রান করেছিলেন। সাথে ২৪.০৪ গড়ে নিয়েছিলেন ২১ উইকেট। এর মধ্যে রঞ্জি ট্রফিতে করেন ১২৮০ রান। তখন রঞ্জির ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে মৌসুমে ১২০০ রান করার কীর্তি গড়েন তিনি।

নির্বাচকরা তাঁকে দলে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। ১৯৯৯ সালে নাইরোবিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক হয়ে গেল। শুরু হল অসংখ্য যদি-কিন্তুতে বোঝাই বিজয় ভরদ্বাজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। সেটা ছিল জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া ও ভারতের মধ্যকার এলজি কাপ ক্রিকেট। ভরদ্বাজ এমন একজন প্রতিভা ছিলেন, ভাবা হচ্ছিল – তিনি রবিন সিংয়ের জায়গাটা নিবেন।

তাঁর ওয়ানডে অভিষেকটা অবশ্য স্মরণীয় সুনীল যোশির অতিমানবীয় বোলিংয়ের কারণে। সেই ম্যাচে ১০ ওভারে মাত্র ছয় রান দিয়েছিলেন যোশি, উইকেট নেন পাঁচটা। সবাই যখন যোশির প্রশংসায় ব্যস্ত, তখন নিভৃতে ১০ ওভার বোলিং করে ১৬ রান দিয়ে একটি উইকেট পান ভরদ্বাজ। এরপর ব্যাটিংয়ে নেমে ১৮ রানে অপরাজিত থেকে ভারতের ফাইনালে যাওয়া নিশ্চিত করেন।

প্রথম টুর্নামেন্টে গিয়েই তিনি সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। সেই আসরে রান মাত্র ৮৯ টি করলেও উইকেট নিয়েছিলেন ১০ টি – সেটাই এই পুরস্কার পাওয়ার কারণ। ভারত নিশ্চিত ছিল যে, তাঁরা ভবিষ্যতের তারকা পেয়ে গেছে।

তাই, মোহালিতে নিউজিলান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষকও হয়ে যায়। তবে, সাদা পোশাকে ‘ডাক’ দিয়ে তাঁর শুরু। বোলিংটাও যুৎসই হয়নি। ফলে, আর দু’টো টেস্ট খেলেই তাঁর বিদায় হয়। এর মধ্যে শেষটা ছিল সেই ম্যাচ যেখানে ভিভিএস লক্ষ্মণ সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তাঁর ভূবনভোলানো ১৬৭ রানের ইনিংস খেলেন।

সেবার ফলোঅনে পড়া ভারতের হয়ে ব্যাটিংয়েই নামা হয়নি ভরদ্বাজের। কারণ মেরুদণ্ডের ডিস্ক সরে গিয়েছিল তাঁর। তাতে, দল থেকে তাঁর জায়গাটাও সরে গিয়েছিল। এই দুর্ভাগ্যজনক ইনজুরি তাঁর ক্যারিয়ার শেষ করে দেয়। আরেকটা সমস্যা ছিল দৃষ্টিশক্তিতে। বরাবরই তিনি চশমা পরে মাঠে নামতেন। কোমরের ইনজুরির সময় চোখের অপারেশনটাও করে ফেলেন। তাতে কাজ তো হয়নি, বরং সমস্যা আরো বেড়েছিল।

তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে খেলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, গুয়াহাটিতে। ২০০২ সালের সেই ম্যাচেও তিনি ছিলেন পার্শ্বনায়ক। দিনেশ মঙ্গিয়ার ম্যাচ জেতানো ১৫৯ রানের দিন তিনি ব্যাট হাতে কিছু করতে না পারলেও ৩২ রান দিয়ে নেন এক উইকেট।

ইনজুরি কাটিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটটা খেলতেন, ভালই করতেন। তবে, যা করতেন সেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই, ২০০৬ সালে তিনি অবসর নিয়ে ফেলেন। কর্ণাটক দলের কোচিং করানো শুরু করেন।

এখানে তিনি লো-প্রোফাইল, তবে খেলোয়াড়ী জীবনের চেয়ে বেশি কার্যকর। তিনি তুখোড় একজন অ্যানালিস্ট। রঞ্জিতে কাজ করার পাশাপাশি তাঁকে আইপিএলেও দেখা গেছে। তবে, লাইমলাইট তাঁর ওপর এখানেও নেই। হয়তো, ভুতুড়ে ইনজুরিটা না আসলে কিংবা লাইমলাইট না হারালে, কিংবা চোখের অপারেশন তাঁর কাছ থেকে আরো বছর পাঁচেক খেলোয়াড় হিসেবে সার্ভিস পেতে পারতো ভারত। কিন্তু, সবার ভাগ্যে কি তা আসে? স্বপ্ন তো কত লোকেই দেখে!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link