ক্রিকেটের রথী, মহারথীদের নিয়ে কতই তো আলোচনা হয়, কত কাব্য রচিত হয়। কিন্তু প্রসঙ্গটা যদি পাল্টে দেই? সর্বকালের সেরাদের নয় বরং সর্বকালের সবচেয়ে বাজে ক্রিকেটারদের যদি কোন তালিকা করা যেত তাহলে কেমন হতো – অবশ্য তালিকা করাটা কঠিন, তবে নির্দিষ্ট একজনের কথা যদি বলতে হয় তাহলে খুব সম্ভবত বিজায়ানন্দ গজপতি রাজুর নাম বলতে হবে। তিনি ছিলেন বিজয়নগরের মহারাজা, ‘স্যার’ খেতাব পাওয়া এক মাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার।
তবে, তাঁর ক্রিকেটীয় পরিচয় এক বাক্যে দেয়া যায় – তিনি আসলে ইমরান খান বা কপিল দেবের ঠিক বিপরীত। ব্যাটিং পারতেন না, বোলিং পারতেন না, ফিল্ডিং পারতেন না এমনকি অধিনায়কত্বও না। বলা বাহুল্য, ক্রিকেটটাই আসলে তিনি পারতেন না।
অথচ এই বিজায়া বুদ্ধি আর ক্ষমতার জোরে ভারতের অধিনায়ক ছিলেন উল্লেখযোগ্য একটা সময়। আর অধিনায়ক থাকাকালীন লালা অমরনাথের মত কিংবদন্তি ব্যাটারকে অপদস্থ করেছিলেন; সিকে নাইডু, ওয়াজির আলীর ক্যারিয়ার থামিয়ে দিয়েছিলেন – ভারতীয় ক্রিকেটকে পিছন দিকে টেনে ধরেছিলেন।
বিজায়ের বাবা ছিলেন বিজিয়ানাগ্রামের জমিদার, সেই সুবাদে ক্রিকেট বোর্ডের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়ে যায় তাঁর জন্য। ভারত যখন ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তখন পাটিয়ালার মহারাজ আর্থিক অনুদান দেন এবং বিনিময়ে ট্রফির নামকরণ করেন রঞ্জিতসিংজির নামে।
অন্যদিকে, বিজায়া একই টুর্নামেন্টের জন্য পাল্টা আরেকটা ট্রফি বানিয়ে লর্ড উইলিংডনের নামে নামকরণ করেন। কিন্তু আর্থিক অনুদানের জোরে চ্যাম্পিয়ন দলের হাতে তুলে দেয়া হয় রঞ্জি ট্রফি। এরই মধ্যে ভারত সফরে আসে অস্ট্রেলিয়ার একটি দল। সে সময় নবাব পতৌদির ভারতীয় একাদশকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা থাকলেও তিনি নিজেকে আনফিট ঘোষণা করে খেলা থেকে সরে যান।
অধিনায়কত্বের দৌড়ে তখন ছিলেন কেবল বিজায়া, নাইডু এবং ওয়াজির আলী। নাইডুকে প্রথম ম্যাচে দায়িত্ব দেয়া হয়, কিন্তু সে ম্যাচ ভারতীয়রা হেরে যাওয়ায় এরপর দায়িত্ব পান ওয়াজির আলী। ওয়াজির সে ম্যাচে ভাল ব্যাট করলেও অধিনায়কত্ব চালিয়ে যেতে রাজি হননি, দলের মধ্যে নোংরা রাজনীতির আভাস পেয়ে নবাব পতৌদিও পুরোপুরি সরে যান খেলা থেকে। ফলে নেতৃত্বের দৌড়ে জিতে যান বিজায়া।
সেটাই কাল হয় ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য; এই আলোচিত ক্রিকেটার পরবর্তী ইংল্যান্ড সফরে যাওয়ার সময় কোন সহ-অধিনায়ক কিংবা নির্বাচক কাউকেই নেননি। বরং দু’জন চাকর এবং উপঢৌকন ভর্তি ৩৬টি লাগেজ নিয়ে গিয়েছেন।
সবমিলিয়ে সেই সফরে ছয় ইনিংস ব্যাট করেছিলেন বিজয়, করেছিলেন ৩৩ রান! ট্যুর ম্যাচ গুলোতে অবশ্য তাঁর ব্যাটিং গড় একটু ভদ্রস্থ, ১৬.২৫। কিন্তু সেটার কারণ ছিল প্রতিপক্ষকে তাঁর দেয়া উপহার। উপহারের বিনিময়ে ফুল টস এবং লোপ্পা বল করতে অনুরোধ করতেন তিনি। যদিও মাঠের বাইরের ঘটনা দিয়েই বেশি আলোড়ন তৈরি করেছিলেন এই ব্যাটার।
আরাধ্য নাইটহুড উপাধি পেয়েছিলেন তিনি; তিনি পুরষ্কার নিতে যাওয়ায় এক ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাইডু। আর সে ম্যাচেই দলকে জিতিয়ে দেন নাইডু – ফলে ড্রেসিরুম দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়; একদিকে ছিল নাইডুর অনুসারীরা, যারা সত্যিই খেলতে চাইতেন। অন্যদিকে, ছিলেন বিজায়ার অনুসারী, যাদের দরকার ছিল কেবল অন্যায় সুবিধা।
কিন্তু ইনফর্ম অমরনাথের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে দলের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছেন জমিদারপুত্র। ফিল্ড প্লেসমেন্ট নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় অমরনাথ এক ম্যাচে তাঁর ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন, এরপর থেকে অমরনাথকে একরকম কোণঠাসা করে ফেলেন তিনি। এমনকি ম্যানেজম্যান্টকে বাধ্য করেন এই কিংবদন্তিকে বাদ দিতে।
স্বাভাবিকভাবেই দলের মধ্যে কোন্দল মারাত্মক রূপ ধারণ করে, তদন্ত কমিটি গঠন করে শুরু হয় সমাধানের চেষ্টা। তাঁদের দেয়া প্রতিবেদনে বিজয়ের সব অপকর্ম ফাঁস হয়ে যায়, তিনি যে ফিল্ডিং সাজানোর কাজটাও পারতেন না সেই গল্প উঠে আসে প্রতিবেদনে। পরবর্তীতে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে, শেষ হয় কুখ্যাত একটা অধ্যায়।