ইয়েলো সাবমেরিনের সেমিফাইনাল যাত্রা

পৃথিবীর ইতিহাসে বহি:শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে কালের বিবর্তনে তৈরি করা হয়েছে বহু দূর্গ। চীনের প্রাচীর উৎকর্ষ এক উদাহরণ হয়ে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দূর্গের সে প্রচলন পরবর্তী সময় ছড়িয়েছে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে। জার্মানির অ্যালিয়েঞ্জ অ্যারেনা তেমনই এক দূর্গ। সে দূর্গ জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের। সে দূর্গ ভেদ করা যে বড্ড দায়। সে তো ভীষণ অসম্ভব!

তবে না, সে দূর্গ একেবারেই অভেদ্য না। সে দূর্গ ভেদ করা যায়। সে দূর্গ ভেদ করে দ্বিতীয় বারের মত সেরা চারে চলে যাওয়া যায়। সে কাজটিই যেন করে দেখালেন উনাই এমেরির শীর্ষরা। স্প্যানিশ ক্লাব ভিয়ারিয়াল তাঁদের ক্লাবের ইতিহাসে দ্বিতীয় বারের মত সেমিফাইনালের টিকিট কেটে ফেলল। শেষ যেবার ভিয়ারিয়াল উঠেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল অবধি তখন লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও নিজেদের আলো ছড়াতে শুরু করেনি।

২০০৫/০৬ মৌসুমে অ্যাওয়ে গোল বিধানে ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলানকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল ‘ইয়েলো সাবমেরিন’ খ্যাত ভিয়ারিয়াল। এরপর আর সত্যিকার অর্থে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পাত্তাই পাওয়া হয়নি তাঁদের। অথচ ইউরোপা লিগে দাপটটা ঠিকই বজায় রেখেছিল ভিয়ারিয়াল। এইতো গত আসরেই সেখানের শিরোপাটা নিজেদে করে নিয়েছিল ক্লাবটি।

ফাইনালে ১-১ ড্র করে এরপর টাইব্রেকারের ১১-১০ ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংল্যান্ডের ‘রেড ডেভিল’ খ্যাত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। নিজেদের সে ফর্মটাই যেন এবার ধরে রেখেছে ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মঞ্চে। ২০০৫/০৬ মৌসুমের পর কেবল আর মাত্র দুইবারই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মূল পর্বে খেলতে পেরেছে। এবার ঠিক নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখার চেষ্টাটা করতেই হত তাঁদের। ভক্ত, সমর্থক সবাই তো তীর্থের কাকের মত একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জেতার অপেক্ষায় রয়েছে। এবারই তবে মোক্ষম সুযোগ।

কেননা কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁরা বিদায় করে দিয়েছে ছয় বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা বিজয়ীদের। তবে কাজটা মোটেও সহজ কাজ নয়। নিজেদের দিনে বায়ার্ন যে ঠিক কতটা ভয়ংকর তাঁর ইতিহাস তো সবারই জানা। ক্লাব ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি বার্সেলোনাকে গুণে গুণে আটখানা গোল দিয়েছিল রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি, টমাস মুলার ও সার্জ গ্যানাব্রিরা। বার্সার ঘরের মাঠে গিয়েই তাঁদের বিরুদ্ধে তাণ্ডব করে এসেছিল বাভারিয়ানরা।

আর তাঁদের বিরুদ্ধেই আতিথিয়েতা দিয়েও ১-০ গোলের একটা স্বস্তির জয় তুলে নিয়েছিল উনাই এমরির শীর্ষ্যরা। অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে যখন জেরার্ড মোরেনো, দানি পারেহোরা খেলতে গেলেন তখন তাঁদের নিশ্চয়ই এই টোটকা দিয়েছিলেন এমরি, এ লড়াইটা লড়তে হবে নিজেদের শতভাগ থেকে খানিকটা বেশি নিঙড়ে দিতে হবে। উনাই এমরি একজন চ্যাম্পিয়ন গোছের ট্যাকটেশিয়ান। তিনি জানেন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেলতে কি করে হয়।

তাঁর অধীনেই স্পেনের আরেক ক্লাব সেভিয়া তিনবার জিতেছিল উয়েফা ইউরোপা লিগ। আর গেলবার তো ইয়েলো সাবমেরিনদেরই চেখে দেখালেন শিরোপার স্বাদ। বাঘের মুখে রক্তের স্বাদ একবার লেগে গেলে নাকি বাঘ হিংস্র হয়ে যা। ভিয়ারিয়ালের খেলোয়াড়দের নিশ্চয়ই শিরোপার ক্ষুধা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তাইতো বায়ার্ন মিউনিখের মত ক্লাবের সাথে তাঁরা লড়েছে একেবারে সমানেসমান। তবে বায়ার্ন হয়ত ভেবে রেখেছিল নতুন তো শিখেছে জেতা, তাঁদের সাথে দুই গোল দিয়ে জেতা যাবে অনায়াসে।

তাঁর আর হল কই? প্রথম লেগের ১-০ জয়, দ্বিতীয় লেগে ১-১ ড্র, সামগ্রিক গোল ব্যবধানে ভিয়ারিয়াল চলে গেল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে। প্রথম দল হিসেবে তাঁরা টিকিট কাঁটে সেমিফাইনালের। তবে দাপট ঠিকই দেখিয়েছিল বায়ার্ন। বলের দখলটা নিজেদের কাছে রেখেই আক্রমণ চালায় নিয়ম করে। তবে সাফল্য ধরা দেয় মধ্যবিরতির পর। ৫২ মিনিটে জাল খুঁজে পেয়েছিলেন লেওয়ান্ডস্কি। তবে উপরে বসে যে এই বিশ্বভ্রমাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছেন তাঁর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন।

ম্যাচের একেবারে অন্তিম মুহূর্তের খানিক আগে ভিয়ারিয়ালের হয়ে বল জালে জড়ান বদলি খেলোয়াড় স্যামুয়েল চুকওয়েজ। সুপার সাব! স্বপ্ন যাত্রার পথে এগিয়ে গেল ভিয়ারিয়াল, ঠিক তখন খেলার ফেরার আর কোন পথই যেন ছিলনা বাভারিয়ানদের। ইয়েলো সাবমেরিনরা, সাবমেরিনের মতই নিশ্চুপে নিজেদের কাজটা করে ফেলল। তাঁদের আনন্দের দিনে প্রধান আকর্ষণই তো ছিল রিয়াল মাদ্রিদ আর চেলসির মধ্যকার ম্যাচ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link