মধ্যরাতে শেষ পর্যন্ত যারা বসে থেকেছেন তারা সম্ভবত একবারও চোখের পাতা ফেলবার সময় পাননি। মৌসুমের শেষপ্রান্তে এসেও ফুটবল রোমাঞ্চ দেখাতে ছাড়ছে না। প্রতিটি লিগের শেষ ম্যাচ ছিল রোমাঞ্চে ভরপুর, সেখান থেকে ইউরোপা লিগ ফাইনালও পিছিয়ে থাকবে নাকি? ২২ পেনাল্টির টাই-ব্রেকার রোমাঞ্চ জিতে নিলো ভিয়ারিয়াল।
উনাই এমেরিকে বলা হয় ‘ইউরোপা লিগ মাস্টারক্লাস’। ইউরোপের দ্বিতীয় স্তরের টুর্নামেন্ট হিসেবে খ্যাত ইউরোপা লিগ। চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ না পাওয়া দলগুলোই জড়ো হয় ইউরোপাতে। আর তাকেই নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছেন উনাই এমেরি।
গত সাত মৌসুমে ফাইনাল খেলেছেন পাঁচবার। এক আর্সেনাল বাদে প্রতি দলকে নিয়েই মাঠ ছেড়েছেন শিরোপা নিয়ে। আর সেই উনাই এমেরিই ভিয়ারিয়াল সমর্থকদের প্রথমবারের মতন মাতালেন শিরোপা জেতার আনন্দে।
ফাইনালের আগে ভিয়ারিয়ালকে তেমন একটা পাত্তাই দেয়নি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইউনাইটেড লিজেন্ড পল স্কোলস তাদের লিগ পজিশন নিয়ে বলতে গেলে এক প্রকার ঠাট্টাই করলেন।
‘লিগে সপ্তম হওয়া দলের সাথে আরামসে জিতবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড’ কিন্তু মাঠে নামতে না নামতেই নিজেদের প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো ভিয়ারিয়াল। ২৯ মিনিটেই ভিয়ারিয়ালকে এগিয়ে দেন জেরার্ড মোরেনো। স্বপ্নের মতন একটা মৌসুম কাটিয়েও ডাক পাননি স্পেন দলে। তার প্রতিশোধ যেন কড়ায়-গণ্ডায় নিয়ে নিলেন ফাইনালে গোল করে। প্রথমার্ধ শেষ হয়েছিল ভিয়ারিয়াল এগিয়ে থেকেই।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটের মাথায় ইউনাইটেডকে সমতায় ফেরান এডিনসন কাভানি। পুরো ম্যাচে বলতে গেলে সে সময়টাই মায়চের উপর একটু আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল ইউনাইটেড। বাকিটা সময় উনাই এমেরি খেলে গিয়েছেন নিজের টিপিক্যাল স্টাইলে।
ফাইনাল, বিশেষ করে ইউরোপা লিগ ফাইনাল কী করে জিততে হয় তা জানা আছে তার। ৯০ মিনিটে ১-১ গোলে শেষ হওয়া ফাইনাল চলে গেল টাইব্রেকারে। এক্সট্রা টাইমে দুই দলের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল দুজনেই খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন টাইব্রেকারে যাওয়ার জন্য। আর টাইব্রেকার শুরু হতেই শুরু হলো রোমাঞ্চ।
টাইব্রেকার মানেই রোমাঞ্চ। এ আর নতুন করে বলবার কী আছে? কিন্তু দুই দলই ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী’ অবস্থা। দুই দলের সকল খেলোয়াড়ের শট নেওয়া শেষ। প্রথম ১০ শটেও আসেনি কোনো ফলাফল। প্রতিটি শটই খুঁজে পেয়েছে জালের দেখা।
অগত্যা শট নিতে হাজির হলেন দুই দলের গোলরক্ষকেরা। ভিয়ারিয়ালের গোলরক্ষক গেরোনিমো রুল্লি ঠাণ্ডা মাথায় ফিনিশ করলেন বটে, কিন্তু পারলেন না ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডে হ্যেয়া। ডে হ্যেয়ার দূর্বল শট থামিয়ে দিলেন রুল্লি। এরপর আর তাদের উল্লাস দেখে কে? নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম শিরোপা জয়ের আনন্দে ভাসলো ভিয়ারিয়াল। আর সে আনন্দে ভাসালেন উনাই এমেরি।
ভিয়ারিয়ালের বেশ সুন্দর একটা গালভরা নাম আছে, ‘ইয়োলো সাবমেরিন’। নাম দিয়েই নিজেদের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করে তারা। হলুদ তাদের জার্সির রং আর সাবমেরিন যেমন সমুদ্রের তলায় থাকে, তেমন অবস্থাটা তাদেরও। ক্লাব তৈরির ৭৫ বছর পর প্রথম লা লিগা খেলার সুযোগ পায় তারা।
বার্সা-রিয়ালের মতন দলের ভিড়ে আজীবন তলানিতেই ছিল তারা। কিন্তু শিরোপার স্বাদ তাদের পাওয়া হয়নি কখনও। তাদের সেরা ফলাফল ছিল ২০০৭-০৮ মৌসুমে। সেবার লা লিগার রানার্স-আপ হয়েছিল তারা। সেগুন্দা ডিভিশন, থার্ড ডিভিশন; সব জায়গাতেই তাদের ফলাফল একটাই; রানার্স-আপ। শিরোপার সাথে তাদের আজীবনের আড়ি।
চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০০৬-০৭ মৌসুমে অনেকদূর গিয়েছিল তারা। কিন্তু নিজেদের লিজেন্ড রিকুইলমের পেনাল্টি মিসের খেসারত দিতে হয়েছিল সেখানে থেকেই। ক্লাব ইরিহাসের ৯৮ বছর পার করে অবশেষে শিরোপার স্বাদ পেল ভিয়ারিয়াল।
কথায় আছে ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’। শতবর্ষের কাছাকাছি এসে অবশেষে শিরোপা স্পর্শ করার সৌভাগ্য হলো তাদের। আর সেটাও উনাই এমেরি আর দানি প্যারেহোর হাত ধরে। শিরোপার জন্য কী না করেছে তারা, তরুণ হুয়ান ফয়েথ ফেটে নাক নিয়ে খেলে গিয়েছেন।
গত মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়া তাড়িয়ে দেওয়া দানি প্যারেহোকে দলে ভিড়েয়েছে তারা। আর্সেনাল থেকে বরখাস্ত হয়ে ভিয়ারিয়ালের দায়িত্ব নিয়েছেন উনাই এমেরি।
দিনশেষে যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে অধিনায়ক ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’ মারিও গ্যাস্পার শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন তখন বলতেই হয়, ফুটবল ইজ ফুল অব ইন্সপায়ারিং স্টোরি।