পরাক্রমশালী কোনো এক দলের সাথে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের টেস্ট ম্যাচ। সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে। ১-১ এ সমতায় আছে দুইদল। ম্যাচটার গুরুত্ব বোঝাতে আর কিছু না যোগ করলেও চলে।
প্রতিপক্ষের দুই ব্যাটার ক্রিজে সেট হয়ে গেছেন। তাদের জুটি ভয়ঙ্কর রুপ নিচ্ছে। রবিচন্দ্রন অশ্বিন কিংবা রবীন্দ্র জাদেজার ঘূর্ণি জাদু কাজে দিচ্ছে নাহ ভারতকে। এমন সময় ওভার শেষে খেলা থামিয়ে বাইরে থেকে নতুন বল আনালেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। আম্পয়ার হয়ে পয়েন্টে দাঁড়ানো কোহলি এবার বলটা হাতে নিয়ে তুলে দিলেন তার বিশ্বস্ত সৈন্য ইশান্ত শর্মার হাতে।
স্লিপে নিয়ে নিলেন তিনজনকে যেখানে বিরাট নিজে দাঁড়ালেন দ্বিতীয় স্লিপে। বল হাতে ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা ইশান্ত দৈত্যের মতো দৌড়িয়ে ঝড়ের বেগে বল ছুঁড়লেন। বল ইনসুইং করে ভিতরে ঢুকার মুখে ব্যাটের কানায় লেগে দ্বিতীয় স্লিপে বিরাটের তালুবন্দি। অত:পর শুরু হলো বুনো উল্লাস।
টেষ্ট ক্রিকেট সম্পর্কে একটু-আধটু খবর রাখা যেকারো কাছে দৃশ্যটি একবার নয় বরং বহুবার লক্ষণীয় হওয়ার কথা। হ্যা কথা বলছি ভারতীয় উপমহাদেশে কপিল দেব এবং ওয়াসিম আকরামের পর তৃতীয় কোনো পেসার হিসেবে ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলা ইশান্ত শর্মাকে নিয়ে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একসাথে দাপিয়ে বেড়ানো বিরাট কোহলি এবং ইশান্ত শর্মা দুজন উঠে এসেছেন দিল্লী থেকে। একই একাডেমি থেকে উঠে আসা বিরাট এবং ইশান্ত শর্মা ছিলেন খুব ভালো বন্ধুৃ। এমনকি কয়েক বছর রুম শেয়ার করেও থেকেছেন দুজন। বিরাট এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি ইশান্ত শর্মাকে অনেকদিন ধরে চিনি। আমরা দুজন প্রায় একই সময়ে খেলা শুরু করেছিলাম। আমাদের অভিষেক ও হয়েছিলো একই দিনে (রঞ্জিতে)। আমরা স্টেট ক্রিকেট এবং রঞ্জি খেলার সময়ে বেশ কয়েকবছর রুমমেটও ছিলাম।’
ইশান্ত শর্মাকে নিয়ে কোহলির এক স্মৃতিচারণ ক্রিকেট পাড়ায় বিশেষ সাড়া ফেলে। কোহলি বলেছিলেন ইশান্ত শর্মার প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার দিনের কথা। ইশান্ত শর্মা প্রথম খবরটা জানতে পারেন বিরাটের কাছ থেকেই।
বিরাট বলেন, ‘যেদিন ও (ইশান্ত) প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পেলো সেদিনের ঘটনা। বিকেল বেলা ইশান্ত ঘুমাচ্ছিলো। আমিই প্রথমে গিয়ে লাথি দিয়ে ওকে ঘুম থেকে উঠাই। প্রথমে শোনার পর ইশান্ত কোনোভাবেই আমাকে বিশ্বাস করছিলো। নিশ্চিত হওয়ার পরে দুজনে একসাথে অনেক আনন্দ করেছিলাম।’
দুই রুমমেট আরো একটি জায়গায় একই সুত্রে গাথা। ইশান্ত শর্মা এবং বিরাট কোহলি দুজনকেই দিল্লী দলে জায়গা করে দিয়েছেন অতুল ওয়াসান, ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য। বিরাট কোহলি’র ব্যাপারে অতুল বলেন, ‘বিরাট আমার অ্যাকাডেমিতে এসেছিলো যখন ওর বয়স মাত্র ১১। আমি তাকে জুনিয়র ক্রিকেটে খুব দ্রুত উন্নতি করতে দেখি। আমিই বিরাট এবং ইশান্তকে দিল্লীর হয়ে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। দিল্লীর ম্যানেজমেন্ট তাদেরকে নিতে চাচ্ছিলো নাহ। কিন্তু আমিই রীতিমতো লড়াই করে তাদের দুজনকে একসাথে একই ম্যাচে রঞ্জিতে অভিষেক হওয়ার ব্যবস্থা করি।’
ইশান্ত শর্মা এবং বিরাট কোহলি’র রঞ্জি অভিষেক হয়েছিল ২০০৬ সালের নভেম্বরে তামিলনাড়ুর বিপক্ষে। বাল্যকালের বন্ধু খুব ভালোভাবেই জানেন কখন ব্যবহার করলে তার থেকে খুব ভালো ফিডব্যাক পাওয়া সম্ভব। তাইতো কোহলির অধিনায়কত্বে ইশান্ত শর্মার বোলিং গড় ঈর্ষনীয়। ইশান্ত শর্মা ধোনির নেতৃত্বে খেলেছেন ৪৭ টেস্ট এবং বিরাটের নেতৃত্বে খেলেছেন ৩৮ টেস্ট। ধোনির অধিনায়কত্বে ১৫২ উইকেট নিয়েছেন ইশান্ত শর্মা যেখানে তার বোলিং গড় ৩৬.৬৫। বিরাটের অধিনায়কত্বে খেলা ৩৮ টেস্টে মাত্র ২৫.৩২ গড় এ ইশান্ত শিকার করেছেন ১১২ উইকেট।
কপিল দেবের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে ১০০ টেস্ট খেলা ইশান্ত শর্মার প্রতি বন্ধু বিরাটের মুখে প্রশংসার কমতি ছিলো নাহ৷ বিরাট বলেন, ‘আমাদের এই কন্ডিশনে পেস বোলারের পক্ষে ১০০ টেস্ট খেলা নিশ্চয়ই বড় অর্জন। অনেক কঠিন সময়ের মাঝে দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু সে পরিশ্রম করে এতদূর এসেছে। ইশান্ত নিজের ক্ষমতার প্রতি খুবই সচেতন। সে জানে কি করলে সফলতা ধরা দিবে।’
অধিনায়ক হিসেবে বিরাট ইশান্তের প্রতি অনেক বিশ্বাস করতেন। যা তিনি নিজেই বলেছেন৷ বিরাট বলেন, ‘আমি ওর সাথে কাজ করতে সবসময়ই আনন্দিত ছিলাম। ইশান্ত খুবই আক্রমনাত্মক বোলার এবং ওর এই জিনিসটা দলের জন্য কাজে দিত। আমি জানতাম ইশান্তকে কখন ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ফল পাওয়া সম্ভব। ও আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং প্লান অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টায় থাকে। শুধু বন্ধু হিসেবে নয় বরং অধিনায়ক হিসেবেও ওর সাথে আমার বোঝাপড়া অনেক ভালো।’
বিরাটের খারাপ সময়েও সবসময় পাশে ছিলেন ইশান্ত শর্মা। বিরাটের অধিনায়কত্ব ছাড়ার পরেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তাঁকে নানা ধরনের বার্তা পাঠিয়েছেন প্রাক্তন এবং বর্তমান একাধিক ক্রিকেটার। তবে তাঁর জন্য সব থেকে আবেগঘন পোস্টটি করেছেন ভারতীয় দলে তাঁরই সতীর্থ তথা তারকা পেসার ইশান্ত শর্মা।
নিজের ইন্সটাগ্রামে ইশান্ত শর্মা, বিরাটের উদ্দেশ্যে এক আবেগঘন পোস্টে লিখেছেন, ‘তোমার সাথে সাজঘরে কাটানো প্রতিটা মূহুর্তের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ছেলেবেলা থেকে মাঠ এবং মাঠের বাইরের প্রতিটা মূহুর্ত, যা আমরা শেয়ার করেছি, তার জন্য ধন্যবাদ। আমরা নিজেদের হৃদয় উজাড় করে ক্রিকেটটা খেলেছি এবং আমাদের সৌভাগ্য আমরা ভাল ফল করতে পেরেছি।’
ইশান্ত আরও লিখেছেন, ‘বিশ্ব ক্রিকেটে ৭ নম্বরে থাকা থেকে শুরু করে, সিনা দেশগুলোতে সিরিজ জয় করে আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তার পিছনে রয়েছে অধিনায়ক হিসেবে তোমার অনবদ্য কর্ম দক্ষতা। আমার এখনও মনে আছে , ২০১৭ সালে তুমি আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে বলেছিলে, সময় এসেছে এখন আমাদের এই দেশগুলোতে সিরিজ জেতার। হ্যাঁ আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাতে ২০১৭-১৮ সিরিজ জিততে পারিনি। তবে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সেখানে তাদের হারিয়েছি। ২০১৭-১৮ সিরিজে ইংল্যান্ডে আমরা ৪-১ ফলে সিরিজ হারলেও, আমরা জানি ঠিক কতটা জয়ের কাছাকাছি আমরা ছিলাম। তাই ভারতের সব থেকে সফল টেস্ট অধিনায়কের জন্য চিয়ার্স। অধিনায়ক হিসেবে তুমি যে সব অসাধারণ মুহূর্ত আমাদের এবং সমগ্র ভারতবাসীকে উপহার দিয়েছ, তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।’