একটা দলে ম্যাচ উইনিং পারফর্ম করা অনেকজন খেলোয়াড় থাকলেও সবাইকে পারফর্মার বলা যায় না।
ইমপ্যাক্ট পারফর্ম্যান্স করে একজন খেলোয়াড় যখন নিয়মিত দলের জয়ে অবদান রাখে তখন তাকে পারফর্মার বলে। জুনায়েদ খান বোলার হিসেবে সেই রকম পাকিস্তান ক্রিকেটের অনেক জয়ে রেখেছে। তবে নিয়মিত জয়ে অবদান রাখলেই ইনজুরির কারণে এই বা হাতি পেস বোলার পাকিস্তান দলে ছিলেন অনিয়মিত।
২০১১ সালে অভিষেক হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২২ টেস্ট, ৭৩ ওয়ানডে ও নয় টি টোয়েন্টি খেলা তারই উদাহরণ। ইনজুরির কারণে এখন পর্যন্ত মাত্র ২২ টেস্টে ই ক্যারিয়ার থেমে গেলেও সাদা বলের ক্রিকেটে অনিয়মিত কিছুটা ভাগ্যেএ দোষের কারণেই এই বাহাতি পেস বোলার।
ওয়াসিম – আকরাম – শোয়েবদের পেস ভূমিতে জন্ম নেওয়া জুনায়েদ খানকে শুধু তাদের উত্তরসূরীই না, পাকিস্তান বোলিংয়ের ভবিষ্যৎ বলে মনে করা হতো।
২০০৮ সালে অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপেই নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে পাকিস্তানের আরেক ভবিষ্যৎ পেস অস্ত্র, তারই সতীর্থ মোহাম্মদ আমির বিশ্বকাপে দারুণ পারফর্ম করে পরের বছর ২০০৯ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পান। পরে তার ভয়নকর পেস বোলিং আগুনে নিজের জায়গা পাকা করে নেন।
জুনায়েদ খানের ভাগ্য দোষ এখানে ই শুরু করা যেতো তবে ২০১০ সালে মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ স্পট ফিক্সিং এর কারণে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হলে পাকিস্তানি নির্বাচক কমিটি জুনায়েদ খানকে সুযোগ করে দেন। সেই সৌভাগ্যের সুযোগটি ও আসে ২০১১ বিশ্বকাপ দলে সোহেল তানভীরের কপাল পুড়ে। শেষ সময়ে সোহেল তানভীরের বদলে ২০১১ বিশ্বকাপ দলে জুনায়েদ খানকে নেওয়া হয়।
সেই বিশ্বকাপে একটি ম্যাচে সুযোগ না পেলেও সেটি ছিলো শোয়েব আখতারের শেষ বিশ্বকাপ। তো তার অবসরের পর জুনায়েদ খানের সেই বছরে ই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাদের মাটিতেই ওয়ানডে ও টি টোয়েন্টি দলে অভিষেক হয়। আবার সেই বছরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জুনায়েদের টেস্ট অভিষেক হয়।
এর পর থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টুকটাক ইনজুরি ছাড়া প্রায় নিয়মিত ৩ ফরম্যাটেই দলে ছিলেন।
সেই সময় জুনায়েদ নিয়মিত পারফরমার হিসেবে দলের অনেক জয়ে অবদান রাখেন। তার সিম ও সুইং এর অনেক ভ্যারিয়েশন ছিলো অনেক কার্যকর। বিশেষ করে ডেথ ওভারে সবচেয়ে বেশি উইকেট পেতো। পাওয়ার প্লে তে ইকোনমিক বোলিং এবং ডেথ ওভারের ভয়নকর বোলিংয়ের পাকিস্তান দলের এক আস্থার নাম হয়েছিলেন জুনায়েদ খান।
তার এই আস্থার প্রতিদান পাকিস্তান ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি মনে রাখবে ২০১২ সালের ভারত- পাকিস্তান ওয়ানডে সিরিজ ও ২০১৩ তে সাউথ আফ্রিকা – পাকিস্তান সিরিজের কারণে।
এই দুইটি সিরিজের সাদৃশ্য হলো দুটি সিরিজেই পাকিস্তান প্রথম দুই ম্যাচ জিতে ২-১ এ সিরিজ জিতে এবং দুইটি সিরিজ ই প্রতিপক্ষের মাঠে জিতে। ভারত সফরে সব বোলাররাই দাপুটে বোলিং করলেও জুনায়েদ খান তাঁর সুইং ও ইকোনমিকাল বোলিং দিয়ে ভারতের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের ঘায়েল করেছিলো। তার মধ্যে ছিল বীরেন্দ্র শেবাগ, বিরাট কোহলি, যুবরাজ সিং, রোহিত শর্মার মতো ব্যাটসম্যানরা। সেই সিরিজে আট উইকেট নিয়ে জুনায়েদ খান সিরিজ জয়ে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষ করে সেই সিরিজের পরই জুনায়েদ খান নিজের আসল জাত চেনান।
আবার ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে জুনায়েদ শেষ ওভারের নয় রান আটকে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নিশ্চিত জয় ছিনিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে পাকিস্তান প্রথম ম ওয়ানডে সিরিজ জয় লাভ করে। জুনায়েদ খান বিপিএল ও নিয়মিত মুখ, খেলেছেন রংপুর রাইডার্স ও খুলনা টাইটানসের হয়ে।
তাছাড়াও ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল ল্যানকশ্যায়ারের হয়েও দুই বছর তাদের ঘরোয়া টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে খেলেছেন। ২০১১ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে ৮ ও ১২ ম্যাচ খেলে ১২ ও ১৯ উইকেট নেন। তাছাড়া ও জুনায়েদ খান ২০১৩ তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সেই বছর ২৮ ম্যাচ খেলে ৫২ উইকেট নিজের নামের পাশে যোগ করেন।
৫/১৪ বেস্ট ফিগারে সে বছর ২বার ৪ উইকেট ও ২ বার ৫ উইকেট পান। ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২.৯৩ ইকোনমিতে ৭১ উইকেট নিয়ে ছিলেন পাকিস্তানের পেস বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। সেই সময়ের পরই তার ক্যারিয়ারে আঘাত হানে ইনজুরি।
২০১৫ বিশ্বকাপের সময় এই ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়েন। ফিটনেস ইস্যু, ইনজুরি এই সব মিলিয়েই পাকিস্তানের টেস্ট ও টি টোয়েন্টি দল থেকে ছিটকে পড়েন। এখন পর্যন্ত ২০১৪ সালে শেষ টি টোয়েন্টি এবং ২০১৫ সালে শেষ টেস্ট খেলেন জুনায়েদ।
এরপরই আসে ভাগ্যের দোষের আগমন। ইনজুরি থেকে ফিরে পারফর্ম করে পাকিস্তান দলে সুযোগ পেতেন তারপর আবার ইনজুরির কারনে বাদ পড়তেন। এসব কারণে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন ট্রফি খেলাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলো। তার সাথে আবার অন্য কারণগুলোর মধ্যে ছিলো মোহাম্মদ আমিরের দলে ফেরা, পাকিস্তান দলে ওয়াহাব রিয়াজের পেস কান্ডারি হয়ে ওঠা, নবাগত রাহাত আলী, হাসান আলী, ইমরান খানদের আগমন।
এসব মিলিয়েই জুনায়েদ খানের আর মূল একাদশে সুযোগ হতো না। তারপরও ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে সুযোগ পেয়ে ৪ ম্যাচে ৪.৫৮ ইকোনমিতে ৮ উইকেট পেয়ে টুর্নামেন্টের ৩য় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন পাকিস্তানকে সেই টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়ে গূরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
তার এই যোগ্যতার প্রমাণ তখন বারবার দেওয়া লাগতো দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য। ২০১৮ এশিয়া কাপে মাত্র ১ ম্যাচে সুযোগ পেয়েই বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৯ রানে ৪ উইকেট নেন। সেই ম্যাচের পর আবার ডাক পান ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে।
সেই সিরিজে দারুণ কামব্যাক করার পর ২০১৯ বিশ্বকাপ ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের ১৯ জনের দলে জায়গা করে নেন। কিন্তু বিশ্বকাপের আগেই ভাগ্যের পরিহাসে ১৫ জনের চূড়ান্ত দলে মোহাম্মদ আমিরের আলোচিত-সমালোচিত অন্তর্ভুক্তিতে বাদ পড়েন জুনায়েদ খান। এরপর আর কোন ফরম্যাটেই দলে সুযোগ পাননি।
করোনা পরবর্তীতে ইংল্যান্ড সিরিজের জন্য পাকিস্তানের ২৯ জনের প্রাথমিক দলেও ছিলো না তার নাম। ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় থেকেই পাকিস্তান দলে সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ বারবার নিজের স্যোশাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ইন্টারভিউতে প্রকাশ করেন।
তাঁর স্ত্রীর পরিবার ইংল্যান্ডের হওয়ায় সে দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ ছিলো জুনায়েদ খানের। কিন্তু তা না করে তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের প্রতি সম্মান রেখে সব সময় খেলতে চেয়েছেন। সেই ইংল্যান্ডে এতো বছর কাউন্টি ও খেলেছেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে সফরের প্রাথমিক দলেও সুযোগ না পেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন জুনায়েদ খান।
৩১ বছর বয়সী এই পাকিস্তানি বাহাতি পেসার পাকিস্তান দলে অনিয়মিত থাকলেও বারবার নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন। এই অনিয়মিত প্লেয়ার এখনো অপেক্ষায় পাকিস্তান দলে ডাক পেয়ে নিয়মিত পারফর্ম করার জন্য।